রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৭ অপরাহ্ন

ভ্যানচালক থেকে শত কোটি টাকার মালিক ইউপি চেয়ারম্যান নবীদুল

  • আপডেট সময় রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৬.৪৬ পিএম
  • ৮ বার পড়া হয়েছে
ছবি: টিডিএস

স্টাফ রিপোর্টার॥
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত কয়েক বছরে শ্রমিক থেকে থেকে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নবীদুল ইসলাম।

জীবন জীবিকার তাগিদে এক সময় শ্রমিক হিসেবে খেতে খামারে দিন মজুরি দৈনিক আয়ে কাজ করতেন তিনি। অতিরিক্ত অর্থ আয়ের জন্য কোন কোন সময় আবার বাসের হেলপারী এবং ভ্যানগাড়িও চালাতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকায় বদলে যায় নবীদুলের ভাগ্যর চাকা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নবীদুল ইসলাম কিশোর বয়স থেকেই বিভিন্ন অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এমনকি চরমপন্থি দলের কনিষ্ঠ সদস্যও ছিলেন তিনি। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন নবীদুল। এরপর ২০০৪ সালে মুলিবাড়ী ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। যুবলীগের পদ পেয়েই দলের মধ্যে নিজের আধিপত্য বাড়াতে সচেষ্ট হন।

ছবি: টিডিএস

এদিকে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দল ক্ষমতায় গেলে বদলে যেতে থাকে নবীদুলের ভাগ্যর চাকা। অল্পদিনেই উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমে সয়দাবাদ এলাকার একচ্ছত্র অধিপত্য বিস্তার করতে থাকে নবীদুল। এরপর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পদও বাগিয়ে নেন তিনি। তারপর জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের আর্শীবাদে ২০১৬ সালে হয়ে যান সয়দাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তারপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

২০১০ সালে মুলিবাড়িতে খালেদা জিয়ার জনসভায় ট্রেন পোড়ানোর ঘটনাটি নবীদুলের জীবনে আসে টার্নিং পয়েন্ট। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া একাধিক মামলায় হাজার-হাজার বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। এসব মামলাকে পুঁজি করে বিএনপি নেতাকর্মী ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ চাঁদাবাজি করেছেন নবীদুল, কেউ টাকা না দিলে তাদেরকে পুলিশের ভয় দেখানো হতো, এমনও অভিযোগ রয়েছে বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল ইসলাম হত্যা মামলাতেও একইভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি বলেন, গত ১৫ বছরে বৈধ-অবৈধ বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কে লোড-আনলোডিং পয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ, নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের শ্রমিক নিয়োগ, প্রতিষ্ঠানটির পুরাতন মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ের টেন্ডার, শিল্পপার্ক ও ইকোনমিক জোনে মাটি ভরাট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুতে শ্রমিক নিয়োগসহ এলাকার সকল ঠিকাদারি কাজই ছিল নবীদুলের নিয়ন্ত্রণে। এলাকায় ব্যবসা করতে নবীদুলকে কমিশন দিতে হয়েছে, নয়তো অংশীদার করতে হয়েছে। এভাবে অবৈধ উপায়ে দুহাত ভরে অর্থ উপার্জন করতে থাকেন নবীদুল। এলাকায় কথিত আছে, তিনি কখনও লাখের হিসেব করতেন না। কোটি কোটি টাকার হিসাব করতেন।

বর্তমানে নবীদুলের তিনটি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। রাজধানী ঢাকায় রয়েছে ৫টি ফ্ল্যাট, কক্সবাজারেও একটি বাড়ি আছে তার। তার মালিকানায় রয়েছে ২২টি ট্রাক, একটি মাইক্রোবাস ও বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল। এছাড়া সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে একাধিক কৃষি-অকৃষি জমি কিনেছেন নবীদুল। আওয়ামী শাসনের গত ১৫ বছরে অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে ভ্যানচালক নবীদুল শূন্য থেকে কয়েকশত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

অর্থ ও সম্পদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা বাড়তে থাকে ইউপি চেয়ারম্যান নবীদুলের। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। তার ভয়ে কেউ কথা বলতে সাহস পেত না। চেয়ারম্যান ও সেই সাথে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্নার একান্ত আস্থাভাজন হয়ে উঠেন নবীদুল।

২০১৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০২০ সালে তার অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে একাধিক মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশ হয়। তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকও তৎপর হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় অদৃশ্য ক্ষমতাবলে সেবার তিনি রেহাই পেয়ে যান। দলের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচনা থাকার পরও ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আবারও লবিংয়ে নৌকা প্রতীক বাগিয়ে নেন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এছাড়াও সয়দাবাদ ইউপি সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা বেলাল হত্যা মামলায় তাকে আসামি করা হয়। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় স্বাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলা থেকে খালাস পেয়ে যান তিনি।

এছাড়াও আরো জানা যায়, সে সময় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকার কারণেই মনোনয়ন বাগিয়ে আনতে সক্ষম হন নবীদুল। এভাবেই ধীরে ধীরে অপ্রতিরোধ্য হওয়া নবীদুল সয়দাবাদ এলাকার গডফাদারে পরিণত হন।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুলিবাড়ী এলাকায় পৈত্রিক ভিটার ওপর দ্বিতল একটি ভবন, মুলিবাড়ী-সিরাজগঞ্জ সড়ক পশ্চিম পাশে ৫ তলা ও পূর্ব পাশে আরও একটি ভবন রয়েছে তার। ঢাকায় ৫টি ফ্ল্যাট ও কক্সবাজারে একটি বাড়ি রয়েছে। ২২টি ট্রাক ছিল তার যার ১৫/১৬টি ইতোমধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। ৪০ লাখ টাকা মূল্যের একটি নোয়া মাইক্রোবাসে চলাচল করতেন নবীদুল। এছাড়াও নিজ গ্রাম মুলিবাড়ী, পূর্ব মোহনপুর, পঞ্চসোনা, জগতলা এলাকায় একাধিক কৃষি-অকৃষি জমিও রয়েছে তারা। বাড়ির পাশেই একটি গরুর খামার রয়েছে ।

আরো জানা যায়,ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে একাধিক বিএনপি নেতাকর্মীকে মারধর এবং হত্যার অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, নিজ দলে তার মতের বিরোধীদের ওপরও চলতো অমানুষিক নির্যাতন। যুবদল নেতা আকবর আলীকে গুলি করে হত্যা, বিএনপি নেতা শহীদকে মারপিট, আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মজনু ও মোয়াজ্জেমের ওপর একাধিক হামলা ও মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সয়দাবাদ ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম এ শহীদ বলেন, নবীদুল চেয়ারম্যানের নির্দেশে গত বছর ২২ নভেম্বর কড্ডার মোড় এলাকায় আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়ে জখম করা হয়। এছাড়াও বাঐতারা গ্রামের বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর ও বাবলু মোহনপুর পশ্চিমপাড়ার জবানকে অমানুষিক নির্যাতন করেছেন নবীদুল। সয়দাবাদ ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক আকবর আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয় নবীদুল চেয়ারম্যানের নির্দেশে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জ শহরে যুবদল ও ছাত্রদলের তিন নেতাকর্মী নিহতের মামলায় সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নবীদুলকেও আসামি করা হয়েছে। পরদিন ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে এখন র্পর্যন্ত তিনি পলাতক রয়েছেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে সয়দাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নবীদুল ইসলামের অফিসে ও তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com