শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৬ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম

হলি আর্টিসান হামলার ৮ বছর: জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রয়ে গেছে শঙ্কা

  • আপডেট সময় সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪, ৪.৩৩ পিএম
  • ১৪ বার পড়া হয়েছে
ফাইল ফটো

স্টাফ রিপোর্টার॥
রাজধানীর কূটনৈতিক পাড়াখ্যাত গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারি ২০১৬ সালের ১ জুলাই অন্যান্য দিনের মতোই তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম শুরু করেছিল। তবে সন্ধ্যা গড়াতেই হলি আর্টিসানের আড্ডাস্থল নেমে আসে অমানিশা।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেখানে চালানো হয় দেশের ইতিহাসের ‘জঘন্যতম জঙ্গি হামলা’। নিমিষেই হলি আর্টিসান পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। ভয়াবহ এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং প্রায় ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস জিম্মি সংকটের ঘটনায় স্তম্ভিত করেছিল পুরো জাতিকে।
আজ রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ৮ বছর হলো। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশি ও ৩ বাংলাদেশিসহ নিহত হন মোট ২২ জন। এই ঘটনায় দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেটে নিহত হন। এছাড়াও গুলি ও বোমায় আহত হন পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য।
কয়েকবার প্রস্তুতি নেওয়া সত্ত্বেও স্পর্শকাতর বিবেচনায় রাতে হলি আর্টিসানে অভিযান চালানো থেকে বিরত থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো সদস্যদের পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ অবসান হয় জিম্মিদশার। নিহত হয় হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি। ভয়াবহ এ জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে জঙ্গিদের নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞের ব্লু প্রিন্ট। বিভিন্ন সময় এ হামলার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের যোগসাজসের বিষয়টিও আলোচনায় আসে।
হলি আর্টিসান হামলার পর ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি হামলা হয়েছিল। তবে ২০২১ সালের পর বড় ধরনের কোনো জঙ্গি হামলা হয়নি। তবে বিভিন্ন সময় জঙ্গিরা চেষ্টা চালালেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
কিন্তু ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর দিনেদুপুরে ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণ থেকে প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। আড়াই বছরেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকা পলাতক দুজনের একজনকেও শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাই বড় কোনো জঙ্গি হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে যতগুলো জঙ্গি সংগঠন সক্রিয় সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও শক্তিশালী আনসার আল ইসলাম। সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনটি নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়ার চেষ্টা করে আসছিল।
জঙ্গি দমনে কাজ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এমন বেশ কয়েকটি বাহিনীর ইউনিটের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আনসার আল ইসলামকে ভারতীয় উপমহাদেশে আল-কায়েদার বাংলাদেশি শাখা (একিউআইএস) বলা হয়। সম্প্রতি আনসার আল ইসলামের কার্যক্রমের ধরন দেখে গোয়েন্দারা সন্দেহ করছেন আল-কায়েদা থেকে নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা পেয়ে মাঠে নেমেছে তারা। বড় কিছু করার উদ্দেশ্যে পুরোনো ও বিশ্বাসযোগ্য সদস্যদের যে কোনো মূল্যে কাছে পেতে চাচ্ছে সংগঠনটি। তবে ঠিক কী নির্দেশনা আনসার আল ইসলামের কাছে এসেছে তা এখনো নিশ্চিত নয়।
গত বছরের ৩০ অক্টোবর গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গি হামলার মামলায় বিশেষ আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত সাত জঙ্গির সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া সাত জঙ্গি হলেন রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ, মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন ও শরিফুল ইসলাম খালেদ। তারা এখন কারাগারে রয়েছেন।
জঙ্গি বিরোধী অভিযানে হলি আর্টিসান হামলায় সংশ্লিষ্ট যারা নিহত হয়েছে:
পুলিশি অভিযান পরিচালনাকালে নিহত হয় জড়িত ৮ জন জঙ্গি। তারা হলেন- তামিম আহমেদ চৌধুরী (৩৩), রুল ইসলাম মারজান (২৩), সারোয়ার জাহান মানিক (৩৫), তানভীর কাদেরী (৪০), বাশারুজ্জামান চকলেট (৩২), মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম (৩৭), মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান (৩২) এবং রায়হানুল কবির রায়হান ওরফে তারেক (২০)।
পুলিশের সিটিটিসির অভিযান:
হলি আর্টিসানের পরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট মোট ৮২৬ জন জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে- জেএমবির ২০০ জন, নিউ জেএমবির ১৮০ জন, আনসাল আল ইসলামের ২৩০ জন, হরকাতুল জিহাদের ১৫ জন, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ১৮ জন, নতুন জঙ্গি সংগঠন ইমাম মাহমুদের কাফেলার ৪১ জন এবং সংগঠন উল্লেখ নেই এমন ২২ জনকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি।
হলি আর্টিসান হামলার পর র‌্যাবের জঙ্গি বিরোধী অভিযান:
হলি আর্টিসানের পর র‌্যাব ১ হাজার ৮৭৫ জঙ্গি সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে ৮৭৩ জন জেএমবি সদস্য, হরকাতুল জিহাদের (হুজিবি) ৩৭ জন, হিযবুত তাহরীরের ১০৪, আনসার আল ইসলামের ৪৭৩ সদস্য, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৮২ সদস্য এবং অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের ৩০৬ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।
ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নব্য জেএমবি’র সদস্যরা হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলা চালিয়েছিল। জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে নব্য জেএমবি। তারপরেও তারা থেমে নেই। যারা গ্রেপ্তার হয়নি বা বাইরে ছিল তারা সংগঠনটিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। তবে সংগঠিত হওয়ার আগেই আমরা তাদেরকে শনাক্ত করেছি। এই মুহূর্তে জঙ্গিবাদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।
জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ পুলিশকে একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন। বাংলাদেশ পুলিশের সন্ত্রাস দমন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। যার অন্যতম উদ্দেশ্য দেশব্যাপী জনসচেতনা কার্যক্রম তৈরি করা। আরেকটি হলো- ডি-রেডিকালাইজেশন। ইতোমধ্যে আমরা এই দুটির কাজ শুরু করেছি। এরইমধ্যে ৫৪ জনকে ডি-রেডিকালাইজেশনের আওতায় আনা হয়েছে। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যারা জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে, প্রাথমিক তথ্য মিলছে তাদেরকে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আনা হচ্ছে। এছাড়া যারা আটক হয়েছে তারা জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় অতীতের আদর্শে অথবা সাজা খেটে বের হচ্ছে তাদেরকে ডি-রেডিকালাইজেশনের আওতায় আনা হয়।
জেলখানায় দুটি ব্যাচকে ডি-রেডিকালাইজেশন করা হয়েছে উল্লেখ করে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, কাশিমপুর কারাগারে দুই দফায় ৮ জন করে মোট ১৬ জনকে এই প্রোগ্রামের আওতায় এনেছি। যারা জামিন পাবেন বা সাজার মেয়াদ শেষ হতে আরও দুই-একবছর লাগবে তাদেরকে নিয়ে এই প্রোগ্রাম করেছি।
র‌্যাবের লিগ্যালা অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, জঙ্গিদের কার্যক্রম বিষয়ে র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। র‌্যাব একের পর এক শীর্ষ স্থানীয় জঙ্গি সংগঠনের নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে। ধারাবাহিক অভিযানের ফলে জঙ্গিরা এখন মাথা চাড়া দিতে পারছে না। এরপরেও আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না।
জামিন পাওয়া জঙ্গিদের ক্ষেত্রে নিয়মিত নজরদারি রয়েছে উল্লেখ করে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যে মামলা হয় সে মামলাগুলো মনিটরিং করা হয়। পাশাপাশি জামিনে বের হওয়া জঙ্গিদের নজরদারি করা হচ্ছে। এছাড়া সাইবার স্পেসে যাতে কেউ উগ্রবাদ ছড়াতে না পারে সেজন্য সাইবার ওয়ার্ল্ডেও নজরদারি করা হয়।
পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি এস এম রুহুল আমিন বলেন, বাংলাদেশে এটিইউ, সিটিটিসি ও র‌্যাব যেভাবে আমরা কাজ করছি তারা মনে করি জঙ্গিদের হামলার কোনও সামর্থ্য নেই। তবে জঙ্গিবাদের বিষয়ে পরিতৃপ্তি থাকা যায় না। পরিতৃপ্তি থাকলেই জঙ্গিরা ভেতরে ভেতরে কাজ করে। আমরা এলারট আছি। সামগ্রিকভাবে খারাপ কিছু আশা করছি না।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com