ডেস্ক রিপোর্ট:
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যয় এখন সরকারি হিসাবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এটাই এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল প্রকল্প।
তবে এই প্রকল্পকে পেছনে ফেলে সর্বোচ্চ ব্যয়ের প্রকল্প হতে যাচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল প্রকল্প। প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় ১৩টি নদীর ওপর রেলওয়ে ব্রিজ নির্মাণের লক্ষ্যে ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ ক্লাসিফিকেশন দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বরাবর অনুরোধ করা হয়েছে। নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স অনুযায়ী প্রস্তাবিত ব্রিজের উচ্চতা বিদ্যমান ব্রিজের চেয়ে বেশি হবে।
প্রকল্পে নিয়োজিত পরামর্শকের মতে, বিআইডব্লিউটিএ প্রয়োজনীয় নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স রেখে ব্রিজগুলো নির্মাণ করা হলে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হবে, যা প্রকল্প বাস্তবায়নে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে এবং প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। স্থানীয় ১৩টি ছোট-বড় নদী-খাল পেরিয়ে সরসারি ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হবে। প্রকল্পের আওতায় গুরুত্বপূর্ণ ৮টি কম্পোনেন্ট রয়েছে। টঙ্গী খাল, বালু নদী, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, ছোট ফেনী, মুহরী, ফেনী, কর্ণফুলী, মাতামুহরী শাখা নদী ও পুরাতন মাতামুহরী শাখা নদী পেরিয়ে রেলপথ নির্মাণ করা হবে। ১৩টি নদীতে নির্মাণ করতে হবে সেতু। সেতুর নিচের অংশের অবকাঠামো কংক্রিকেটর, অন্যদিকে উপরের অংশের অবকাঠামো হবে স্টিলের। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটা সেতুর উচ্চতাও বৃদ্ধি করতে হবে।
ফলে মূল প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়ে দাঁড়াবে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদনের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই হবে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প। প্রাথমিক হিসেবে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৬ হাজার কোটি টাকা কিন্তু ব্রিজগুলোর উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেই মূলত প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ রেলওয়ের এক ঊর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, মূলত চলমান কারিগরি প্রকল্পের উপর নির্ভর করে মূল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বিআইডব্লিউটিএর নির্দেশনা অনুযায়ী ১৩টা নদীর নেভিগেশনাল হাইট (উচ্চতা) নিয়ে আলোচনা চলছে। আমরা ধারণা করেছিলাম ৭৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। তবে নদীতে ব্রিজের উচ্চতা বৃদ্ধি করা হবে। ফলে প্রকল্পের ব্যয় আরো ৪০ শতাংশ বাড়বে। সেই হিসেবে প্রকল্পের ব্যয় ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা হবে। ’
মূল প্রকল্প গ্রহণের জন্য ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল প্রকল্প প্রস্তুতিমূলক সুবিধার জন্য কারিগরি সহায়তা’ শীর্ষক প্রকল্প চলমান। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কারিগরি প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে প্রকল্পের কাজ চলমান। এই প্রকল্পের পরেই মূল প্রকল্প শুরু হবে। কারিগরি প্রকল্পটি ২১২ কোটি ৬৪ লাখ ৩১ হাজার টাকায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। বর্তমানে প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ। ইতোমধেই প্রকল্পের আওতায় ১৬০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, সেতুগুলোর উচ্চতা বৃদ্ধির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভার্টিকেল ২ দশমিক ১২ মিটার থেকে হরাইজন্টাল সর্বোচ্চ ৭৬ দশমিক ২২ মিটার হতে হবে। হরাইজন্টাল নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স অনুসরণে ব্রিজের নির্মাণ কারিগরিভাবে বাস্তবসম্মত হবে। তবে ভার্টিকেল নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স বাস্তব অবস্থার তুলনায় অধিক হওয়ায় রেল ব্রিজ নির্মাণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। বিআইডাব্লিউটিএ ভার্টিকেল নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স সমুন্নত রেখে ব্রিজ নির্মাণের ক্ষেত্রে ২৩ কি . মিটার ভায়াডাক্ট নির্মাণ এবং ৬২ কিলোমিটার এমব্যাংকমেন্টের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে। এছাড়া অধিকাংশ ব্রিজের পাশে রেলওয়ে স্টেশন বিদ্যমান থাকার কারণে প্রায় এক কিলোমিটার স্টেশন ইয়ার্ড রেইজ অথবা স্টেশন ইয়ার্ড স্থানান্তর করার প্রয়োজন হবে; যা ব্যয় সাপেক্ষ।
বিআইডব্লিউটিএ প্রদত্ত নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স রেখে রেলওয়ে ব্রিজসমূহ নির্মাণ করতে হলে অতিরিক্ত বিশাল অর্থের প্রয়োজন হবে। বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিয়োগে নির্মিত প্রকল্পের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যান্ড ইকোনোমিক ইন্টারনাল রেল অব রিপটার্ন গ্রহণযোগ্য হবে কিনা সন্দিহান রেলওয়ের। চলমান কারিগরি প্রকল্পের মাধ্যমেই সম্ভাব্য ব্যয় বের করা হয়েছে। অধিকাংশ অর্থই দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে এডিবি। সংস্থাটির ঋণের পাশাপাশি সরকারি অর্থও ব্যয় হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, এটা বিশাল ব্যয়ের প্রকল্প হবে। আমরা ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ করে সরকারের কাছে প্রস্তাব করবো। এটা জিওবি (সরকারি অর্থায়ন) অর্থায়নে হবে না প্রকল্প ঋণ নেবে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে জানায়, পদ্মা নদীর ভাটি এবং বঙ্গোপসাগরের মুখে ছোট ছোট নদীসহ গুরুত্বপূর্ণ নৌ-রুটে সেতু নির্মাণের সময় আবশ্যিকভাবে নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্সের বিধি-বিধান প্রতিপালন করতে হবে। অথবা সেতুতে এক বা একাধিক লিফটিং স্প্যানের ব্যবস্থা রেখে সেতুর নকশা প্রণয়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় ১৩টি নদীর ওপর রেলওয়ে ব্রিজ নির্মাণের লক্ষ্যে ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ ক্লাসিফিকেশন দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বরাবর অনুরোধ করা হয়েছে। নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স অনুযায়ী প্রস্তাবিত ব্রিজের উচ্চতা বিদ্যমান ব্রিজের চেয়ে বেশি হয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত মিটার গেজ রেলপথ থাকলেও নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে ডুয়েল গেজে রূপান্তর করা হবে। পাশাপাশি ফৌজদারহাট থেকে একটি কার্ভ বা কর্ডলাইন নিয়ে ষোলশহর রেলস্টেশনে যুক্ত করা হবে। ঢাকা থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত একটি কর্ডলাইনও নির্মাণ করা হবে। ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে সরাসরি রেলপথ চলে যাবে কক্সবাজার পর্যন্ত। বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে আসা ট্রেনগুলোর শেষ গন্তব্য চট্টগ্রাম স্টেশন হওয়ায় সাইডিং লাইনে ট্রেন কক্সবাজারে যেতে সময়ক্ষেপণ হবে। এজন্য নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে ফৌজদারহাট থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার কর্ডলাইন নির্মাণ করে ষোলশহর স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা চলছে। এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে রেলওয়ে।
দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ৯৯ দশমিক ৩ কিলোমিটার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৯৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। অর্থাৎ প্রকল্পের আওতায় মোট ১২৭ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার সিংগেল লাইনকে ডুয়েল গেজ ট্রাক নির্মাণ করা হবে, যা পরে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে। এছাড়া রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সুবিধা আরও বাড়বে। সবগুলো কাজ বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হবে ৭৬ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। সোর্স: বাংলা নিউজ