ডেস্ক রিপোর্ট॥
কয়েকদিন ধরেই দেশজুড়ে জেঁকে রয়েছে শীত। দু-এক দিনে শীতের এ তীব্রতা কমে আসার সম্ভাবনাও নেই। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কুয়াশার কারণে রোদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। তীব্র শীতে মানুষ যেমন দুর্ভোগে পড়েছে, তেমন উরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ফসল উৎপাদনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। একই সঙ্গে বিপাকে পড়েছেন খামারিরা।
কৃষি বিভাগ বলছে, এসময় মাঠে বোরোর বীজ বপন করা হয়েছে। ধানের বয়স ৪০ দিন বা ৪৫ দিন হলে চারা তুলে মাঠে রোপণ করা হয়। এছাড়া আলুসহ বিভিন্ন শীতকালীন সবজি; ডাল, গম, সরিষাসহ তৈলবীজ জাতীয় ফসল মাঠে রয়েছে। যেগুলো ঘন কুয়াশার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শীতকালীন ফসলে বিভিন্ন রোগের আক্রমণ শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কৃষি কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক এসব ফসল রক্ষায় বাড়তি যত্ন ও ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
এ শীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বোরোর বীজতলা। ঘন কুয়াশার কারণে বীজতলার গোড়া ও পাতা পচা রোগ এবং চারা হলুদ বর্ণ হয়ে মারা যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে বীজতলা লালচে হয়ে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। কৃষকরা বীজতলা রক্ষায় নানান পদক্ষেপ নিলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তা কাজে আসছে না।
এসময় ঠান্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা এবং চারার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য বীজতলা রাতে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখার পরামর্শ দিয়েছে কৃষি বিভাগ। বীজতলা থেকে পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিতে হচ্ছে। এছাড়া প্রতিদিন সকালে চারার ওপর জমা হওয়া শিশির ঝরিয়ে দিতে বলা হচ্ছে কৃষি বিভাগ থেকে।
চলমান পরিস্থিতি নিয়ে নওগাঁ কোলা এলাকার কৃষক করিম উদ্দিন বলেন, পরামর্শ দেওয়া হলেও সেগুলো কাজে আসছে না। কারণ শীতের তীব্রতা ক্রমেই বাড়ছে। অনেক খরচ করে পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। পরামর্শ অনুযায়ী বালাইনাশক প্রয়োগ করা হয়েছে। তারপরও ভালো ফল আসছে না। একদিকে উৎপাদনে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে, অন্যদিকে চারা রক্ষা করতে না পারলে বোরো চাষে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।
পরামর্শ দেওয়া হলেও সেগুলো কাজে আসছে না। কারণ শীতের তীব্রতা ক্রমেই বাড়ছে। অনেক খরচ করে পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। পরামর্শ অনুযায়ী বালাইনাশক প্রয়োগ করা হয়েছে। তারপরও ভালো ফল আসছে না। একদিকে উৎপাদনে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে, অন্যদিকে চারা রক্ষা করতে না পারলে বোরো চাষে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।
বোরোর পরে শঙ্কায় রয়েছে আলু। বগুড়ার শীবগঞ্জের চাষী এনামুল হক বলেন, তার প্রায় ১১ বিঘা জমিতে নাবি ধসা রোগের আক্রমণ হয়েছে। ছত্রাকনাশক স্প্রে করেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ আবহাওয়ার কোনো উন্নতি হয়নি। বরং দিন দিন ওই এলাকায় তাপমাত্রা কমছে, বাড়ছে কুয়াশা।
এ পরিস্থিতি নিয়ে বগুড়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মতলুবার রহমান বলেন, চলমান আবহাওয়া আলু উৎপাদনকারী সব জেলায় খারাপ প্রভাব ফেলেছে। বগুড়ায় ১১৯ হেক্টর জমি এ পর্যন্ত নাবি ধসা রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, এমন আবহাওয়ায় আলুর মড়ক রোগ এড়াতে কৃষকদের প্রতি লিটার পানিতে তিন গ্রাম হারে ম্যানকোজেব ছত্রাকনাশক ও মেটালেক্সিল এক গ্রাম হারে স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছি। প্রতিটি কৃষককে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, এ পরিস্থিতিতে অধিদপ্তর থেকে প্রয়োজন সাপেক্ষে সবখানে ধানের বীজতলা এবং আলু ক্ষেতে পলিথিনের শেড নির্মাণে কৃষকদের সহায়তা করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কৃষকদের অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বালাইনাশকগুলোর সরবরাহ ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতেও কাজ করা হচ্ছে।
কৃষি বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রির নিচে চলে গেলে ধানের চারাগাছ হলুদ হয়ে যেতে পারে, তখন তা খাদ্য তৈরি করতে পারবে না। চারা মরে যেতে পারে। পাশাপাশি রাতের তাপমাত্রা যখন ২০ ডিগ্রির নিচে চলে আসে ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার জন্য আর্দ্রতা ৮০ বা ৯০ পারসেন্ট হয়ে যায়, তখন শীতকালীন ফসলে বিভিন্ন রোগের আক্রমণ হয়। এখন অধিকাংশ এলাকায় এ পরিস্থিতি চলছে। এছাড়া এসময় যেসব ডাল ও তেল জাতীয় ফসল চাষ হয়, ঠান্ডা ও ভেজা আবহাওয়া এসব ফসলে রোগ বিস্তারের জন্য অনুকূল।
তারা বলছেন, এসময় মসুর ডাল গোড়া-পচা রোগে আক্রান্ত হয়। সরিষাতে দেখা দেয় কাণ্ড পচা রোগসহ অলটারনারিয়া ব্লাইট। পাশাপাশি বিভিন্ন ফল গাছের নানান ধরনের রোগ হয়। এছাড়া মরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটাসহ শীতকালীন সবজির গাছ মরে যায়।
এ অবস্থায় কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে-
>> কুয়াশা ও মৃদু/তীব্র শীতের এ অবস্থায় বোরো ধানের বীজতলায় ৩-৫ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখতে হবে।
>> ঠান্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা এবং চারার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য বীজতলা রাতে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, বীজতলা থেকে পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিতে হবে এবং প্রতিদিন সকালে চারার উপর জমাকৃত শিশির ঝরিয়ে দিতে হবে।
>> আবহাওয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে আলুর নাবী ধ্বসা রোগের আক্রমণ হতে পারে। প্রতিরোধের জন্য অনুমোদিত মাত্রায় ম্যানকোজেব গোত্রের ছত্রাকনাশক ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
>> সরিষায় অলটারনারিয়া ব্লাইট রোগ দেখা দিতে পারে। রোগ দেখা দেওয়ার সঙ্গে অনুমোদিত মাত্রায় ইপ্রোডিয়ন গোত্রের ছত্রাকনাশক ১০-১২ দিন পর পর ৩ থেকে ৪ বার স্প্রে করতে হবে।
>> ফল গাছে নিয়মিত হালকা সেচ প্রদান করতে হবে। কচি ফল গাছ ঠান্ডা হাওয়া থেকে রক্ষার জন্য খড়/পলিথিন শিট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত পোল্ট্রি-গবাদিপশু
এদিকে গত দেড় সপ্তাহ থেকে মুরগির উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে বলে দাবি করছেন খামারিরা। বিভিন্ন স্থানে শীত বৃদ্ধির ফলে মুরগি ও ডিমের দামও বাজারে বেড়েছে।
শীতের কারণে মুরগির অপুষ্টি, রাণীক্ষেত, মাইকোপাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি মুরগির অপুষ্টিজনিত সমস্যাও বেশ প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কয়েকদিনের ব্যবধানে তিনটি গরু খুরা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বাকি আটটি গরু নিয়ে আমি চিন্তিত। এগুলো বাহিরে নেওয়া যাচ্ছে না। খাবার ও ওষুধের খরচ অস্বাভাবিক বেড়েছে। উল্টো দুধের পরিমাণ আগের থেকে অর্ধেকে নেমেছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, শীতে সবকিছুর মতো পোল্ট্রি খাতও প্রভাবিত হয়েছে। রোগ বেড়ে গেছে। কমে গেছে উৎপাদন।
উপকূলীয় অঞ্চলে অনেকেই হাঁস পালন করে থাকেন। এসময় হাঁসের নানান ধরনের রোগও হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন খামারি। তারা জানান, এখন প্লেগ, কলেরা ও বটুলিজম রোগের প্রকোপ বেড়েছে শীতের কারণে।
অন্যদিকে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রবল শীতের কারণে গবাদিপশু শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। গরু ও ছাগলের নিউমোনিয়ায়সহ স্থানীয়ভাবে খুরা রোগের প্রকোপ বেড়েছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া গবাদিপশু রোগের পাশাপাশি খাদ্য সংকটে অপুষ্টিতে ভুগছে। ফলে ওজন কমছে, কমে যাচ্ছে দুধ উৎপাদন।
রংপুরের শঠিবাড়ির কৃষক আমিনুর রহমান বলেন, কয়েকদিনের ব্যবধানে তিনটি গরু খুরা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বাকি আটটি গরু নিয়ে আমি চিন্তিত। এগুলো বাহিরে নেওয়া যাচ্ছে না। খাবার ও ওষুধের খরচ অস্বাভাবিক বেড়েছে। উল্টো দুধের পরিমাণ আগের থেকে অর্ধেকে নেমেছে।