ডেস্ক রিপোর্ট॥
দিন দিন বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য তুলা আমদানির ক্ষেত্র হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আফ্রিকার দেশগুলো। বর্তমানে আমদানিকৃত তুলার ৫০ শতাংশের বেশিই আসছে এসব দেশ থেকে।
প্রতি বছর দেশে তুলার চাহিদা কম-বেশি ৮৫ লাখ বেল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তুলা আনা হলেও দীর্ঘদিন ধরেই ভারতনির্ভর ছিল বাংলাদেশ। কালক্রমে সে উৎসে পরিবর্তন এসেছে। চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই ভারতের স্থান দখল করে নিয়েছে আফ্রিকার দেশগুলো।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আফ্রিকার তুলা বাণিজ্যে বড় ভূমিকা রাখছে সৌদি আরবের জেদ্দাভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি)। ঋণদাতা এ সংস্থাটির অর্থায়ন সুবিধা কাজে লাগিয়ে মালয়েশিয়ার ক্ল্যাং বন্দরে ওয়্যারহাউজ গড়ে তুলেছেন আফ্রিকা অঞ্চলের তুলা রফতানিকারকরা। সেখান থেকে চাহিদা অনুযায়ী সাতদিনের মধ্যেই তুলা আনতে পারছেন দেশের আমদানিকারকরা। তৃতীয় একটি দেশের বন্দর ব্যবহারের এ সুবিধাই বাংলাদেশের তুলা আমদানির উৎস পরিবর্তনের মূল অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, দেশে গুদামজাত করে তুলা রাখার ক্ষেত্রে নানা জটিলতা রয়েছে। ইনভেন্টরিতে ইন্টারেস্ট রেট অনেক বেড়ে যায়। এ কারণে তৃতীয় একটি দেশের বন্দরের ওয়্যারহাউজ ব্যবহার করা হয়।
‘আফ্রিকা অঞ্চল থেকে যারা তুলা রফতানি করেন তাদের অনেকেরই মালয়েশিয়ার ক্ল্যাং বন্দরে ওয়্যারহাউজ আছে। শিপাররা বাংলাদেশের চাহিদা বিবেচনায় সেখানে তুলা গুদামজাত করেন। মাত্র সাতদিনের মধ্যে তা নিয়ে আসা যায়। মূলত এ সুবিধার কারণেই আফ্রিকা অঞ্চল থেকে পণ্যটির আমদানি ক্রমেই বাড়ছে।’
বাংলাদেশের তুলা আমদানির গতি-প্রকৃতিকে বিপণন বর্ষভিত্তিক (আগস্ট থেকে জুলাই) হিসাব করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার (ইউএসডিএ)। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যের ভিত্তিতে ইউএসডিএ বলছে, ২০২২-২৩ বিপণন বর্ষে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি তুলা আমদানি হয়েছে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে, যা মোট চাহিদার ৩৯ শতাংশ। ৯ শতাংশের উৎস ছিল ক্যামেরুন। ৩ শতাংশ আমদানি হয় শাদ থেকে। এ হিসেবে মোট তুলা আমদানির ৫১ শতাংশই হয়েছে আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলো থেকে। এছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল থেকে আমদানি হয়েছে ১৬ শতাংশ। প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলা আসে ১২ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ১০ শতাংশ তুলা।
আফ্রিকা অঞ্চলে উৎপাদিত তুলার গুণগত মান বেশ ভালো বলে জানান বস্ত্র খাতসংশ্লিষ্টরা। মানের পাশাপাশি সময় ও প্রতিযোগিতামূলক দামের কারণেও এ অঞ্চল থেকে তুলা আমদানি বাড়ছে বাংলাদেশে।
মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ক্যামেরুনের তুলার মান বেশ ভালো। তারপর শাদ ও মালির তুলাও ভালো।
‘তবে আফ্রিকার তুলা আমদানি বেড়ে যাওয়ার আরো একটি কারণ হলো আফ্রিকান কটন অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির সদস্যদের আইডিবির পক্ষ থেকে বিশেষ অর্থায়ন ব্যবস্থার সুবিধা দেওয়া হয়। ফলে তারা ভালো মানের তুলা প্রতিযোগিতামূলক দামে ও কম সময়ে রফতানি করতে পারছে। সে সুবিধাটাই নিতে পারছেন বাংলাদেশের মিল মালিকরা।’
এক সময় উজবেকিস্তানের তুলা জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল বাংলাদেশে। কিন্তু শিশুশ্রমের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সে উৎস থেকে সরে আসতে হয়।
মূল্য ও আমদানির সময় বিবেচনায় একসময় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল ভারত। যদিও দেশটির তুলাজাত সুতা-কাপড়ের মান ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আবার নিজস্ব চাহিদা মেটাতে গিয়ে রফতানি নিষেধাজ্ঞার মতো অশুল্ক বাধাও আসত দেশটির পক্ষ থেকে। এসব জটিলতায় বিকল্প উৎস হিসেবে কালক্রমে আফ্রিকার তুলার চাহিদা বেড়েছে বাংলাদেশে।
বিটিএমএর তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাংলাদেশ মোট তুলা আমদানি করে ৫২ লাখ বেল। এর মধ্যে ভারত থেকে আসে ১১ লাখ বেলের বেশি। এ হিসাবে সে বছর ২২ শতাংশ তুলা আমদানি হয়েছে প্রতিবেশী দেশটি থেকে। ২০১৫ সালে মোট ৬১ লাখ বেল তুলা আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ভারত থেকে আনা হয় ২৯ লাখ বেল। পরের বছর আমদানীকৃত তুলার ভারতের অংশ ছিল প্রায় ৫৫ শতাংশ। বতর্মানে এ হার কমে ১২ শতাংশে এসে ঠেকেছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশ ভালো মানের তুলা থেকে সুতা উৎপাদন করে, যার প্রতিফলন হিসেবে মোট তুলা আমদানিতে আফ্রিকা ও যুক্তরাষ্ট্রের অংশ বাড়ছে। অর্থাৎ ভারতের চেয়ে ভালোমানের তুলা ব্যবহার করে দেশে সুতা তৈরি হচ্ছে। এসব সুতা ও কাপড়ের তৈরি পোশাক বিশ্ববাজারে রফতানি করছে বাংলাদেশ।