ডেস্ক রিপোর্ট॥
ঈদযাত্রায় ট্রেনের টিকিটে কারসাজি এখনো কমেনি। কালোবাজারিরা নতুন পদ্ধতিতে বাড়তি দামে বিক্রি করছেন এসব টিকিট। ঈদযাত্রার সব ট্রেনের টিকিট বিক্রি শেষ হওয়ার পর এখনো বিভিন্ন রুটের অনেক টিকিট কালোবাজারে পাওয়া যাচ্ছে। শুক্রবার এক টিকিট কালোবাজারির কাছে ঐ ৬ ও ৭ এপ্রিলের ৭টি টিকিট চাইলে তিনি জানান, টিকিট দেওয়া যাবে। তবে এজন্য তাকে বাড়তি প্রায় ৪ হাজার টাকা দিতে হবে।
যাত্রীরা জানান, ৬ এপ্রিল দিনাজপুরগামী ট্রেনে সকাল ৮টা থেকে ট্রেনের টিকিট বিক্রি শুরুর পর সর্বোচ্চ ৫ সেকেন্ডের মধ্যে একাধিক ফোন থেকে চেষ্টা করেও ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায়নি। আসন ফাঁকা দেখালেও টিকিট কাটতে গেলেই দেখাচ্ছে বুকড (বিক্রি হয়ে গেছে)। এক কালোবাজারির কাছে দুটি টিকিট চাইলে তিনি আধা ঘণ্টার মধ্যে পাঠিয়ে দেন। ১ হাজার ৬০০ টাকার দুটি টিকিটের জন্য তাকে দিতে হয়েছে ৩ হাজার টাকা। ৬ এপ্রিলের টিকিট অনলাইনে বিক্রি শেষ হয়েছে গত বুধবার। অথচ বাড়তি টাকা দিয়ে শুক্রবারও সেই টিকিট পাওয়া গেছে।
ঐ টিকিট কালোবাজারির নাম রাজু। তিনি দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়ার বাসিন্দা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকা থেকে ফুলবাড়িয়ার ৭ এপ্রিলের ৪টি ও ৮ এপ্রিলের ৩টি টিকিট চাইলে তিনি বলেন, ‘একটু অপেক্ষা করেন, খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি।’ ১৫ মিনিটের মধ্যে রাজু ফোন করে আশ্বস্ত করলেন যে দেওয়া যাবে। দাম কত জানতে চাইলে রাজু জানান, ৭ এপ্রিল একতা এক্সপ্রেসের চারটি এবং ৮ এপ্রিল চিলাহাটি এক্সপ্রেসের তিনটি টিকিট হবে। ভাড়া পড়বে ৭ হাজার টাকা। অথচ ঢাকা থেকে ফুলবাড়ী পর্যন্ত আন্তঃনগর ট্রেনের শোভন চেয়ারে প্রকৃত ভাড়া ৪২৫ টাকা হিসাবে মোট ভাড়া ২ হাজার ৯৭৫ টাকা।
টাকা কিছুটা কম নেওয়ার কথা বললে রাজুর জবাব, ‘কম নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ টিকিট আমি আরেকজনের কাছ থেকে নিই। টিকিটের অনেক চাপ। ফাও কথা বলার সময় নেই।’ নিজের দুটি নম্বর (০১৭৩৮০২৭৩৫৩ ও ০১৭০৪৩৫৫৮৫৭) দিয়ে রাজু বললেন, ‘এখানে বিকাশ, নগদ সব অ্যাকাউন্ট আছে। দ্রুত টাকা পাঠান, না হলে পরে কিন্তু টিকিট পাবেন না।’
তার দেওয়া দ্বিতীয় নম্বরটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর এবং সেটি আরিফ নামে নিবন্ধন করা আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, রাজু একসময় ফুলবাড়িয়া স্টেশনে পান, সিগারেটের ব্যবসা করতেন। দীর্ঘদিন ধরে ঐ ব্যবসা করার সুবাদে টিকিট কালোবাজারির সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এখন তিনি পানের ব্যবসা বন্ধ করে টিকিট কালোবাজারি করেন ফুলবাড়িয়াতে বসেই।
সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের হাতে একবার ধরাও পড়েছিলেন তিনি। কিছুদিনের মাথায় ছাড়া পেয়ে আবারও এ কালোবাজারি শুরু করেন।
ট্রেনের টিকিট বিক্রিতে কালোবাজারি বন্ধে গত বছরের ১ মার্চ থেকে ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ এমন স্লোগান সামনে রেখে অনলাইনে ও অফলাইনে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। পাশাপাশি ঈদ উপলক্ষে এবারই প্রথম মোবাইলে ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এর ফলে একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে সর্বোচ্চ চারটি টিকিট সংগ্রহ করা যাবে। এভাবে ঈদযাত্রার টিকিটে সর্বোচ্চ দুবার (যাওয়া-আসা) একজন টিকিট কিনতে পারবেন।
অনলাইনে রেলের টিকিট বিক্রির দায়িত্বে থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সহজ ডট কম ও রেলওয়ের অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী কালোবাজারিতে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। এবার ঈদযাত্রার টিকিট বিক্রি শুরুর আগে রেলওয়ের কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন ওটিপি পাঠানোর এ পদ্ধতি নতুন চালু হওয়ায় টিকিট নিয়ে কারসাজি অনেকটা কমবে। কিন্তু বাস্তবে তা কমেনি।
টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার পর মুহূর্তেই টিকিট শেষ হয়ে যাচ্ছে। আবার অনলাইনে আসন ফাঁকা দেখালেও টিকিট কিনতে গেলে সেটি বিক্রি দেখাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সহজ ডট কমের প্রযুক্তিগত জালিয়াতির পাশাপাশি নানা কৌশলে কালোবাজারি চক্র বিভিন্ন রুটের টিকিট আগে থেকেই সংগ্রহ করে রাখছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
কালোবাজারি চক্রের হোতা রাজু জানান, টিকিট তারা সংগ্রহ করলেও ইচ্ছেমতো পরিচয়পত্র দিয়ে টিকিট কাটা যাবে। ট্রেনের ভেতর কোনো সমস্যা হবে না।
ঈদযাত্রার টিকিট বিক্রি শুরুর আগে রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম জানিয়েছিলেন, টিকিট বিক্রির কালোবাজারি বন্ধে নানা উদ্যোগ নেয়ার ফলে এবার ঈদে যাত্রীদের টিকিট নিয়ে ভোগান্তি বন্ধ হবে।
তিনি বলেছিলেন, ‘টিকিট বিক্রি শুরুর পর ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এই টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে একটি সিন্ডিকেট জড়িত। যাদের সঙ্গে সহজের লোক এবং রেলের লোকও জড়িত। এরই মধ্যে আমরা দুটি সিন্ডিকেটকে ধরে আইনের আওতায় এনেছি। ঠিকমতো টিকেটিং ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য সহজকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া টিকিট কালোবাজারি বন্ধে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’
দেশব্যাপী ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে সম্প্রতি সহজ ডট কমের কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর আগে, ২৬ জানুয়ারি ১৪ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১ হাজার ২২৪টি টিকিট জব্দ করা হয়। তারা প্রতিদিন কালোবাজারির মাধ্যমে ৫ শতাধিক টিকিট সংগ্রহ করে বেশি দামে বিক্রি করতো।
গ্রেফতাররা রেলস্টেশনে কর্মরত অসাধু কর্মচারী, সহজ ডটকমের অসাধু কর্মকর্তা এবং সার্ভার রুম ও আইটি শাখার কর্মীদের সহযোগিতায় ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করতো বলে জানিয়েছে র্যাব।
টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১০ দিনে রেলওয়ের তিনজন বুকিং সহকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। টিকিট কাটার জন্য তারা কালোবাজারি ও দালালদের সরবরাহ করা অজ্ঞাত নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করতো। এছাড়া স্টেশনের টিকিট কাটতে আসা যাত্রীদের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও মোবাইল ফোন নম্বর ডায়েরিতে টুকে রাখতো। তারপর সময় সুযোগমতো সেসব পরিচয়পত্রের নম্বর ও মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে টিকিট কেটে কালোবাজারিদের হাতে তুলে দিতো।
কালোবাজারির পাশাপাশি জাল টিকিট বিক্রিরও প্রমাণ মিলেছে। কম্পিউটারের দোকান থেকে অনলাইনে টিকিট কাটার পর পিডিএফ কপি রেখে দেওয়া হয়। এ কপি এডিট (সম্পাদনা) করে নতুন আসন বসানো হয়। এমনকি কাউন্টার থেকে কাটা টিকিট স্ক্যান করে সম্পাদনার মাধ্যমে ইচ্ছেমতো আসনও বসানো হয়। এভাবেই ট্রেনের জাল টিকিট বিক্রির ডিজিটাল অপরাধী চক্র সক্রিয়। এতে সাধারণ যাত্রীরা প্রতারণার শিকার হওয়ার পাশাপাশি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের আর্থিক জরিমানা ও কারাদণ্ডের মুখোমুখি হন।
কালোবাজারি চক্র এখন নতুন পদ্ধতি হিসেবে টিকিট রিফান্ড (ফেরত দিয়ে নতুন টিকিট সংগ্রহ) করে ফের টিকিট নিয়ে তা বিক্রি করছে। অর্থাৎ তারা আগেই টিকিট কেটে রাখে। এরপর যাত্রী জোগাড় করে কোনো এক ফাঁকে কাউন্টারে গিয়ে টিকিট রিফান্ড করেই সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীর এনআইডি, নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে টিকিট করে দিচ্ছে। ফলে ট্রেনে যাত্রীর টিকিট পরীক্ষা করলেও তা যে কালোবাজারিদের কাছ থেকে কেনা তা আর ধরার উপায় থাকে না।