সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের ঘটনায় ২০১২ সালে হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী জেসমিন ইসলাম, তার কিছু কর্মী এবং ব্যাংকটির কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়। দীর্ঘ এক যুগ পর গত মঙ্গলবার একটি মামলায় তানভীর মাহমুদ ও তার স্ত্রী জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া অন্য সাতজন হলেন তানভীরের ভায়রা হলমার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ, টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, প্যারাগন গ্রুপের এমডি সাইফুল ইসলাম রাজা, সাইফুল হাসান, নকশি নিটের এমডি মো. আবদুল মালেক ও আবদুল মতিন।
আমরা কিছুটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারি যে একটা রায় তো হলো। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? হলমার্ক ছাড়াও তো অনেক বড় বড় কেলেংকারি ও বেনামি ঋণের নামে ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কারও কিছু হয়নি, বরং তারা ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরেই ঘোরাঘুরি করছে।
আর্থিক খাতের দৈন্যদশা দূর করতে না পেরে এখন একীভূতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত আর্থিক খাত প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে অর্থনীতির সংকট দূর করা যাবে না। একীভূত করার প্রক্রিয়া চলুক, তবে লুটপাটকারীদের শাস্তি না হলে এ উদ্যোগও সুফল দেবে না। আমাদের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড ব্যাংক খাত বাঁচাতে না পারলে দেশ বাঁচবে কী করে?
২০২২ সালে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে। সে বছর ইসলামী ব্যাংকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে। যার সঙ্গে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়। ২০০৮ সালের পর ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে বেসিক ব্যাংকে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নানা অনিয়মের মাধ্যমে এ ব্যাংকটিতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ৬০টির মতো মামলা করেছে। বেসিক ব্যাংকের আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। তার বিরুদ্ধে দুদকের পক্ষ থেকে ৫৮টির বেশি মামলা করা হলেও বাচ্চুকে গ্রেফতার করা হয়নি। এখন তিনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কয়েক ধাপে জনতা ব্যাংকে ঘটে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা। ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপ এ ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিল। এদের কিছু হয়নি এবং হয়নি ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. আবুল বারকাতের, যাকে প্রকাশ্যে দায়ি করেছিলেন সে সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
২০২১ সালে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক) ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের আর্থিক খাতে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা সামনে আসে। এই পি কে হালদারের কারণে পিপলস লিজিং এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং আজ অস্তিত্বহীন।
২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সাবেক ফারমার্স ব্যাংককে(বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) নাই করে দেওয়ার জন্য দায়ী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের এখন পর্যন্ত কিছু হয়নি। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে শহিদুল আহসানের ৭০১ কোটি টাকা, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে এবি ব্যাংকে ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে। তিনি যথারীতি ব্যবসা করছেন এবং একটি টিভি চ্যানেলের এমডি হিসেবেও বসে আছেন।
রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাবেই এসব ঘটনা ঘটছে। কারণ ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই করছেন সব অনিয়ম। খুঁটির জোরেই তারা থেকে যাচ্ছেন আইনের দৃষ্টির বাইরে। অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ব্যাংকি ও আর্থিক খাতের সব অনিয়ম আর জালিয়াতির সঙ্গে রাজনীতির যোগ রয়েছে।
সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই নিয়োগ পান। ঋণ বিতরণ ও ঋন মওকুফজাতীয় সব কাজের সাথে তারা জড়িত থাকেন। তারা অসদুপায় অবলম্বনে ঋণ বিতরণ করার প্রক্রিয়া করে দেন। বিতরণ করা ঋণের বেশিরভাগই অসৎ উপায় অবলম্বন করে এমন লোকদের ঋণ দেওয়া হয়, যারা পরবর্তীসময়ে ঋণের টাকা যথাসময়ে পরিশোধ করছে না।
ব্যক্তিখাতের ব্যাংকগুলোতেও রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্তরা তাদের আধিপত্য কায়েম করে ব্যবস্থাপনাকে নিজেদে কব্জায় নিয়েছেন। তাছাড়া সরকার আইন করেই ব্যাংকে থাকা জনগণের টাকা তথাকথিত মালিকদের হাতে তুলে দিয়েছে। এরা সবগুলো ব্যাংকে তাদের জমিদারি কায়েম করেছেন। একজন একক ব্যক্তির হাতে সাতটির মতো ব্যাংক চলে গেছে, তিনি এক ব্যাংকের টাকা দিয়ে অন্য ব্যাংক কিনেছেন, প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়েছেন এবং পাচার করছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম ছিল কোনো ব্যাংক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকের মূলধনের ৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারবে না। ৫ শতাংশের বেশি ঋণ বিতরণ করে তা ফেরত পাওয়ার সক্ষমতা ছিল না বলেই ২০০১ সালে এই নিয়ম চালু করা হয়। ২০১০ সালের পর এই নিয়ম উঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে ব্যাংকিং খাতে অসদুপায়ে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা শুরু হয়। এটা করাই হয়েছিল লুটপাটের সুযোগ দেওয়ার জন্য।
আর্থিক খাতের দৈন্যদশা দূর করতে না পেরে এখন একীভূতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত আর্থিক খাত প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে অর্থনীতির সংকট দূর করা যাবে না। একীভূত করার প্রক্রিয়া চলুক, তবে লুটপাটকারীদের শাস্তি না হলে এই উদ্যোগও সুফল দেবে না। আমাদের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড ব্যাংক খাতকে বাঁচাতে না পারলে দেশ বাঁচবে কী করে?
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।