টানা চতুর্থবারের মত আ. লীগের বিজয়
ডেস্ক রিপোর্ট॥
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের মাধ্যমে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। আর শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন বিশ্বরাজনীতিতে। বিশ্বে শেখ হাসিনাই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন নারী সরকারপ্রধান।
এরই মধ্যে চার মেয়াদে ২০ বছর সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
নানা শঙ্কা, আতঙ্ক ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে গতকাল রবিবার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ২৯৯ আসনের মধ্যে রাত ২টা পর্যন্ত পাওয়া খবরে আওয়ামী লীগ ২২৩, স্বতন্ত্র ৫৬, জাতীয় পার্টি ১১, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে বিজয়ী হয়েছে। ময়মনসিংহ-৩ আসনে ফলাফল স্থগিত রাখা হয়েছে।
বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো ভোট বর্জন করায় আওয়ামী লীগের জয় ও পরবর্তী সময়ে সরকার গঠন অনেকটা নিশ্চিত থাকলেও নির্বাচনকে ঘিরে নানা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ছিল।
বেশ কিছুদিন ধরে দেশব্যাপী অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতার কারণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে সংশয়ও দেখা দেয়। তবে তুলনামূলক কিছুটা কম ভোটার উপস্থিতি, কয়েকটি আসনে গোলযোগ ও অনিয়মের অভিযোগ ছাড়া মোটাদাগে শান্তিপূর্ণভাবেই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়।
গতকাল সকাল ৮টায় শুরু হয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট চলে। এরপর ভোট গণনা।
সন্ধ্যার পর থেকে একে একে নির্বাচনী আসনগুলো থেকে ফলাফল আসতে শুরু করে। সর্বশেষ ফলাফলে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়েছে। আগামী সপ্তাহে নতুন সরকারের যাত্রা শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। এরপর দীর্ঘ সামরিক শাসন শেষে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়।
কিন্তু ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের আসনে বসে। এরপর ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের জয়যাত্রা শুরু হয়। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ ও ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। সেই হিসাবে ২০০৮ সালের পর থেকে টানা চতুর্থবার এবং ১৯৭৩ সাল থেকে মোট ষষ্ঠবার সরকার গঠন করে রেকর্ড সৃষ্টি করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, চলতি সপ্তাহেই নির্বাচনের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করা হবে। এরপরই নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করবেন। তারপরই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার শপথগ্রহণ করবে। নির্বাচনে শেখ হাসিনা তাঁর পিতৃভূমি গোপালগঞ্জ-৩ (টুঙ্গিপাড়া-কোটালীপাড়া) আসন থেকে আবারও বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি এ নিয়ে এই আসন থেকে অষ্টমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন।
গতকাল সকাল ৭টা ৫৫ মিনিটে শেখ হাসিনা তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিককে নিয়ে রাজধানীর সিটি কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিতে যান। ঢাকা-১০ আসনে নৌকার প্রার্থী ফেরদৌস আহমেদ তাঁদের স্বাগত জানান। ভোট দেওয়ার পর তিনি দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই দেশের উন্নতি হয়েছে। আমাদের সামনে আরো কাজ আছে, এগুলো সম্পন্ন করতে চাই। জনগণের ওপর আমার আস্থা আছে।’
এদিকে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, এবারের নির্বাচনে ৪০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। নির্বাচনে গুরুতর সহিংসতা হয়নি। যেখানে অনিয়ম হয়েছে, সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এই নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতিই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সেই চ্যালেঞ্জে অনেকটা জয়ী বলে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এমনকি নানা আশঙ্কা ও আতঙ্ক থাকলেও সফলভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে বলে ইসি দাবি করেছে। কয়েকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা ভোট বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছেন।
নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ রাখতে তফশিল ঘোষণার পর থেকেই সতর্ক ছিল ইসি। নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি নির্বাচনী আচরণবিধি পালনে বাধ্য করেছে প্রার্থী ও তাঁদের কর্মী সমর্থকদের। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে শোকজ, তলব, জরিমানা ও মামলা করা হয়েছে প্রার্থী ও তাঁদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে। দুজন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর প্রার্থিতা বাতিল করেছে ইসি।
গতকাল ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। এর আগেও নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল ইসি। নির্বাচনের দিনও আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন তিনি। তিনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে হুমকি দিয়েছেন। এসব কারণ বিবেচনায় নিয়ে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও সারা দেশে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। মুন্সীগঞ্জে একজনের মৃত্যু, চট্টগ্রামে বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, চট্টগ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষে দুজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনে অনিয়ম, সংঘাত ও জোর করে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগে কয়েকটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে। জোর করে সিল মারার অভিযোগে একজন মন্ত্রীর ছেলেকে আটকের নির্দেশ দিয়েছে ইসি। ওই অভিযোগে একটি কেন্দ্রের ভোট বাতিল করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানা গেছে, সারা দেশে ৩৭টি স্থানে অনিয়ম ও গোলযোগের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। জাল ভোটের অভিযোগে ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। বরগুনায় একজনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে চট্টগ্রামের একজন মহিলা চেয়ারম্যানকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া জাল ভোট দেওয়ার কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন আসন থেকে ১০ জনকে আটক করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ফরিদপুর-৩ আসনের অনেক কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদ। একটি কেন্দ্রে তাঁকে ঘেরাও করা হয়েছে বলে অভিযোগও করেন তিনি। কক্সবাজার-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় বর্তমান এমপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলম ভিডিও বার্তায় অভিযোগ করেছেন, ‘দুপুর ১২টার পর থেকে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা ও বিজিবি আমার এজেন্টদের পিটিয়ে বের করে দিয়ে সব কেন্দ্র দখল করে। এটা প্রতিহত করতে গিয়ে প্রাণহানির চেয়ে আমি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালাম।’
একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে নওগাঁ-২ আসনের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। সারা দেশে ২৯৯টি আসনের ৪২ হাজার ১০৩টি কেন্দ্রের দুই লাখ ৬১ হাজার ৯১২টি কক্ষে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে। ইসিতে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিচ্ছে। নির্বাচনী লড়াইয়ে এক হাজার ৫৩৪ জন রাজনৈতিক দলের মনোনীত ও বাকি ৪৩৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশ নেন।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৬৬ জন, জাতীয় পার্টির ২৬৫ জন ও তৃণমূল বিএনপির ১৩৫ জন প্রার্থী রয়েছে। এবারই প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। এর মধ্যে ছয় কোটি সাত লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন পুরুষ ও পাঁচ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন নারী। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ৮৫২ জন ভোটার রয়েছেন। আর প্রথমবারের মতো ভোট দেবে এক কোটি ৫৪ লাখ ৫২ হাজার ভোটার।
নির্বাচনে সব আসনেই সনাতন পদ্ধতিতে ব্যালট পেপার ব্যবহার করে ভোট গ্রহণ করা হয়। কারচুপি এড়াতে বেশির ভাগ কেন্দ্রে রবিবার সকালে ব্যালট পেপার যায়। অবশ্য দুর্গম এলাকাগুলোতে আগের দিন ব্যালট পেপার পৌঁছানো হয়। প্রায় আট কর্মকর্তা ভোটগ্রহণে দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনে দুই শতাধিক বিদেশি ও ২০ হাজার ৭৭৩ জন দেশি পর্যবেক্ষক ভোট পর্যবেক্ষণ করেছেন। বিদেশি ৯২ জনসহ ১০ হাজারের বেশি সাংবাদিক নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ভোটকে ঘিরে সারা দেশে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। হরতাল ঘিরে যেকোনো ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে নেওয়া হয় কঠোর ব্যবস্থা। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসহ সাতটি বাহিনীর প্রায় আট লাখ সদস্য ভোটের মাঠে দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচন উপলক্ষে ৭২ ঘণ্টা মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও ভোটারদের সুবিধার্থে এবারই প্রথম গণপরিবহন চালু রাখা হয়।