শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৫ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম

দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদ ও পহেলা বৈশাখ: পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার তাঁতীরা পার করছেন ব্যস্ত সময়

  • আপডেট সময় বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০২৪, ১.৫০ পিএম
  • ১৫ বার পড়া হয়েছে
সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার সারটিয়া গ্রামের দুই নারীকে তাঁত শিল্পের একটি ইউনিটে সুতা প্রস্তুত করতে দেখা যাচ্ছে। ছবি: দ্য ডেইলী স্কাই

 ভারতের ব্যবসায়ীরাও ভিড় করছেন

সিরাজুল ইসলাম শিশির ও আমিনুল ইসলাম॥
রমজানের ঈদ ও পয়লা বৈশাখকে সামনে রেখে পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া অঞ্চলের তাঁত পল্লীগুলো কর্মমুখর হয়ে উঠেছে। তাঁত মালিক ও শ্রমিকেরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিকমানের আধুনিক রুচিশীল শাড়ি ও লুঙ্গি। শাড়ির ওপরে বর্ণিল সুতা, বাক ও চুমকির কাজ করা হচ্ছে। এ ছাড়া কাপড়ের ওপর রঙ তুলির আঁচড়ে হাতে করা হচ্ছে মনোমুগ্ধকর নানা নকশা। আর এই নান্দনিক নানা নকশার তৈরি টেকসই কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ভারতের পশ্চিমবাংলাসহ বিভিন্ন রাজ্যে।
ইতিমধ্যেই তাঁতপল্লিগুলোতে বেড়েছে শ্রমিকদের ব্যস্ততা। পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে তাঁতের শাড়ি ও লুঙ্গির জমজমাট ব্যবসা হয়। তবে রং, সুতা, কেমিক্যাল ও বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বাড়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁত মালিকদের, দ্য ডেইলী স্কাই পত্রিকার সাথে কথা বলতে গিয়ে এমনই তথ্য প্রদাণ করেছেন অনেক মালিক ও ব্যবসায়ীগণ।


জানা যায়, তাঁত সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, চৌহালী, এনায়েতপুর, ও সদরের একাংশ মিলে তিন লাখেরও বেশি ইঞ্জিন এবং হস্তচালিত তাঁত রয়েছে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ।
সরেজমিন দেখা গেছে, জেলার বিভিন্ন তাঁতপল্লিতে তৈরি হচ্ছে আধুনিক মানের জামদানি, সুতি জামদানি, সুতি কাতান, বেনারসি ও বিভিন্ন ধরনের লুঙ্গি। সেই সঙ্গে পাইকারি ব্যবসায়ীদের আনাগোনাও বেড়েছে।
এ অঞ্চলের তাঁতপল্লিগুলোয় তৈরি উন্নতমানের শাড়িসহ বিভিন্ন কাপড় দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। ঢাকার বড় বড় বুটিক হাউজগুলো তাদের পরিবেশকের মাধ্যমে ভারতের কলকাতা, শুভরাজ, গঙ্গারামপুর, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁতের কাপড় বাজারজাত করছে। বগুড়ার শেরপুরের ঘোলাগাড়ী বেনারসি পল্লী, পাবনার ঈশ্বরদী ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, চৌহালীতে তৈরি তাঁতবস্ত্র ইতোমধ্যে ভারতসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ঈদ ও পয়লা বৈশাখ সামনে রেখে এখানকার কাপড়ের চাহিদা বাড়ছে। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কাপড় তৈরি করছেন তাঁত কারখানার মালিকরা। কাপড়ের উৎপাদন বাড়াতে কাজ করে চলেছেন তাঁত শ্রমিকরা। মালিক ও শ্রমিকদের কোলাহলে সরব হয়ে উঠেছে তাঁত পল্লী। বসে নেই নারীরা। পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে নলীভরা, সুতাপারি করা, মাড়দেয়া ও রঙ তুলিতে নকশা আঁকাসহ কাপড় বুননের কাজে সহযোগিতা করছে ওই এলাকার নারী শ্রমিকরা। বাজারে কাপড়ের চাহিদা বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে দাম। এই মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসাবে রঙ-সুতাসহ তাঁত উপকরণের মূল্য বৃদ্ধিকেই দায়ী করছেন তাঁত কারখানা মালিকরা।

পাবনার সুজানগর উপজেলার দোগাছির তাঁত মালিক আব্দুল্লাহ বলেন, আন্তর্জাতিক মানের এবং সময় উপযোগী ডিজাইন নিয়ে আসায় দেশীয় তাঁত শিল্প প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তাঁতিরা এ শিল্পকে আর অলাভজনক পেশা হিসেবে দেখছেন না। পুরনো আমলের বুনোন শৈলী ও জ্যাকেট পাইড়ের শাড়ি বাদ দিয়ে ডিজাইনারদের পরামর্শ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ শিল্পকে সমৃদ্ধ করছেন। ঈদ ও পয়লা বৈশাখ সামনে তাঁতের কাপড় বিক্রিতে এখন আর মন্দাভাব নেই। এ পেশার সাথে জড়িত সবাই এখন লাভের মুখ দেখছেন। সময় উপযোগী করে বুনোন শৈলী নান্দনিক ও মনোমুগ্ধকর নানা নকশা আর রঙের মাধুর্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে এ অঞ্চলের তাঁতের কাপড়। এ দিকে ঈদের বাজারে সোনার বাংলা টেক্সটাইল, ডিসেন্ট, চাচকিয়া, ওয়েস্ট, রংধনুসহ ১২৫ ব্র্যান্ডের লুঙ্গি চাহিদা বেড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
এ সময় কয়েকজন তাঁত মালিক জানান, রং, সুতা, কেমিক্যাল ও কাঁচামালের দাম বাড়ায় তাঁতের শাড়ি ও লুঙ্গির উৎপাদন খরচ বেড়েছে। উৎপাদন খরচের সঙ্গে তুলনা করে বাজারজাত করতে পারছেন না। এ ছাড়া ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে তাঁত শ্রমিকদের কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
বেলকুচির তামাই এলাকার তাঁত মালিক আবুল কাশেম বলেন, ‘কয়েক বছর আগে করোনার কারণে আমাদের তাঁতশিল্প কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। গত বছর থেকে ব্যবসা মোটামুটি ভালো হচ্ছে। কিন্তু রং ও সুতার দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। সেজন্য বেশি লাভবান হতে পারছি না।’
একই এলাকার রমজান আলী জানান, তার কারখানায় শ্রমিকরা দিন-রাত কাজ করছেন। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ডার আসছে। রং ও সুতার বাজার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে আবারও ঘুরে দাঁড়াবে জেলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প।
তাঁত শ্রমিক রাশিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারে সবকিছুর দাম বেশি, রমজানে খরচ আরও বেশি হচ্ছে। তাই এ বছর বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে। প্রতিদিন যে টাকা আয় হচ্ছে তা দিয়ে কোনোরকম পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে আছি।’
বেলকুচিতে শাড়ি কিনতে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল মোমিন ব্যাপারী বলেন, ‘সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন তাঁতপল্লি থেকে তাঁতের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা কিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, করটিয়া, বাবুরহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করে থাকি। এখানে ৫০০ টাকা শুরু করে কয়েক হাজার টাকা দামের শাড়ি পাওয়া যায়। বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা এখানে এসে শাড়ি ও লুঙ্গি কিনে নিয়ে যান।’
এদিকে সম্প্রতি শাহজাদপুর হাটে ভারতীয় কয়েকজন কাপড় ব্যবসায়ী জানান, ভারতের পশ্চিমবাংলার উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলি, বর্ধমান, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কুচবিহার, হাওড়া ও হুগলিসহ বিভিন্ন জেলার ছোট-বড় নামীদামি শপিংমল ও বিপণিবিতানগুলোতে বাংলাদেশে তৈরি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শাড়ি বিক্রি হয়। রমজানের ঈদ ও বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে সেখানে বাংলাদেশী শাড়ির বাজার জমে উঠতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার তাঁত কারখানাগুলোতে তৈরি সিল্ক জামদানি, সুতি জামদানি, কাতান, সুতি কাতান, রাজশাহী সিল্ক, বেনারসি, চোষা, শেড, স্বর্ণলতা, কটন শাড়ি ভারতে রফতানি হচ্ছে। আর এই মনোমুগ্ধকর নানা নকশার তৈরি উন্নতমান, টেকসই, রুচিশীল শাড়ির দাম কম হওয়ায় পশ্চিমবাংলার মহিলাদের বেশি পছন্দ বাংলাদেশী শাড়ি।
পশ্চিমবাংলার শিলিগুড়ির আমদানিকারক সেলিম খান জানান, রমজানের ঈদ ও পয়লা বৈশাখের বাজার ধরার জন্য পশ্চিমবাংলার আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা আতাইকুলা, শাহজাদপুরহাট, এনায়েতপুরহাট, করোটিয়াহাট, বাবুরহাট ও ডেমরাহাট থেকে শাড়ি কিনছেন। এ ছাড়া রাজশাহীর সিল্ক, গরদ, পাবনার ঈশ্বরদীর বেনারসি কাতান, সিরাজগঞ্জের স্বর্ণলতা, চোষা ও শেড শাড়ি, টাঙ্গাইলের সুতি জামদানি, সিল্ক জামদানি ঢাকার মিরপুরের বেনারসি, কাতান ও নারায়ণগঞ্জের ডেমরার জামদানি তাঁত কারখানাগুলোতে গিয়ে পছন্দমতো শাড়ি কিনে পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলার শপিংমল, বিপণিবিতানগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে।॥
বিবিআনা, রঙ, কে-ক্রাফট ও নাগরদোলাসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় বুটিক প্রতিষ্ঠানের কাপড় এখন সিরাজগঞ্জ-পাবনা অঞ্চলে তৈরি হয়। বুটিক হাউজগুলোর নিজস্ব ডিজাইনে রেশম সুতা, খাদি, নয়েল, ডুপিয়ান ও এন্ডি সুতা ব্যবহার করে তাতে প্যালেস ও জরি মিশ্রিত করে কাপড় তৈরি করা হচ্ছে। বুটিক হাউজের ওড়না থান কাপড় ও এন্ডি থান কাপড়ের ফ্রেবিকস তৈরি করা হচ্ছে তাঁত পলীগুলোতে। এ দিয়ে নানা ধরনের পোশাক তৈরি করছে বুটিক হাউজগুলো। তরুণ-তরুণীদের কথা মাথায় রেখে তাঁতীরা উন্নতমানের জামদানি নকশা, শেড ও থান কাপড় তৈরি করছে। জামদানি থ্রিপিচ আড়াই হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা এবং চেক থ্রিপিচ এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বেলকুচি উপজেলা হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ার লুম অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বৈদ্যনাথ রায় ‘দ্য ডেইলী স্কাই’ কে বলেন, ‘বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন অর্ডার আসছে। পাইকাররা এসে পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা যদি এগুলো নিয়ে বিক্রি করতে পারেন তাহলে এ ব্যবসার সফলতা আসবে। আর তারা যদি বিক্রি করতে না পারেন তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব।’
সিরাজগঞ্জ হ্যান্ডলুম এবং পাওয়ারলুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বদিউজ্জামান মন্ডল ‘দ্য ডেইলী স্কাই’ কে বলেন, ‘রোজার ঈদকে সামনে রেখে শাড়ি ও লুঙ্গি তৈরিতে ব্যস্ত তাঁতিরা। প্রতিনিয়তই রং, সুতাসহ তাঁতের উপকরণের দাম বাড়লেও কাপড়ের দাম না বাড়ায় এ শিল্পে রুগ্ণতা সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া এ বছর রোজার ঈদকে সামনে রেখে প্রায় হাজার কোটি টাকার কাপড় বেচাকেনার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বাজারে এখনো তেমন সাড়া পাচ্ছি না। তাই ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখতে রং, সুতা ও কাঁচামালের দাম কমাতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু ইউসুফ সূর্য্য ‘দ্য ডেইলী স্কাই’ কে বলেন, ‘তাঁতশিল্প সিরাজগঞ্জের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ শিল্পের সঙ্গে অনেক মানুষ জড়িত রয়েছে। তাই শিল্পকে রক্ষা করতে রং, সুতাসহ বিভিন্ন কাঁচামালের দাম কমাতে হবে। তাঁতিদের কম সুদে ঋণ ও ভর্তুকি দিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই এ তাঁতশিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে।’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com