প্রভাষ আমিন
‘বাঁশরিয়া বাজাও বাঁশি দেখিনা তোমায়
গেঁয়ো সুর ভেসে বেড়ায় শহুরে হাওয়ায়।‘
কবির সুমনের এই গানের গেঁয়ো সুরের টানে ঈদ এলেই মানুষ ছুটে বাড়ির পানে। দুই কোটি মানুষের চাপে পিষ্ট এই ঢাকা। ঈদ এলেই ঢাকা হালকা হয়ে যায়, যেন একটু শ্বাস ফেলার সময় পায়। ঈদের ছুটিতে সপ্তাহখানেক চেনা ঢাকা অচেনা হয়ে যায়। ঢাকার এ মাথা ও মাথা তখন আধঘণ্টার দূরত্ব। বাংলাদেশ ছোট্ট একটা দেশ, ১৮ কোটি মানুষ। এই ছোট্ট দেশটি আরো বেশি ছোট লাগে সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায়। মানুষ জীবিকার খোঁজে ঢাকায় ছুটে আসে। চাকরি, ব্যবসা, শিক্ষা, চিকিৎসা- সবকিছু মেলে ঢাকায়। কিন্তু সেই গেঁয়ো সুর সবাইকে, ফেলে আসা গ্রাম, সেই মাটিতে পোতা নাড়ি আমাদের টানে। তাই তো মানুষ যানজট, ভোগান্তি জেনেও গ্রামের পানে ছোটে। বাস, ট্রেন, লঞ্চ, বিমান, সাইকেল, মোটর সাইকেল, ভ্যান, রিকশা- যে যেভাবে পারেন; গ্রামের পানে ছোটেন। শত ভোগান্তির পরও ঠিক জন্ম ভিটায় পা রাখলে, মায়ের আঁচলের ছায়া পেলে সব ক্লান্তি ভুলে যায়। হেমন্ত মুখার্জির সেই গানের মত যেন ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা কোলে তব মা গো, বলো কবে শীতল হবো’। তবে ছুটি শেষে আবার সেই ঢাকায় ফিরতেই হয়। নাড়ি গ্রামে পোতা হলেও পেটের দায় মানুষকে ঢাকায় টেনে আনে।
চাকরি, ব্যবসা, শিক্ষা, চিকিৎসা। ঢাকায় ছুটে আসার আরো অনেক কারণ আছে। নদীভাঙ্গনে বা অন্য কোনোভাবে নিঃস্ব হওয়া মানুষ ঢাকায় ছুটে আসে। অনেকে পালিয়ে আসে ঢাকায়। মিশে যায় জনস্রোতে। এই ঢাকা অনেকের ভাগ্য যেমন বদলে দেয়। আবার অনেকে আরো নিঃস্ব হয়। গ্রামের
খোলা হাওয়া ছেড়ে ঢাকায় আসা অনেকের জীবন কেটে যায় পথে, স্টেশনে, বস্তিতে। ঢাকা আসলে একটা ফাঁদের মত। একবার আটকালে এই ফাঁদ থেকে বেরোনো মুশকিল। আশির দশকেতর শেষ দিকে আমি ঢাকা এসেছিলাম মূলত পড়াশোনা করতে। তারপর আর ফেরা হয়নি। সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইট-কাঠের এই জঞ্জালে আটকে আছি। বাবা শুয়ে আছেন গ্রামে মসজিদের পাশে। মাসহ আমাদের পরিবারের সবাই এখন ঢাকায়। তাই অন্য অনেকের মত আমার আর গ্রামে যাওয়ার তাগিদ নেই। তাগিদ নেই বটে, কিন্তু টান তো আছে। আমি সবসময় বলি, পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা আমার গ্রাম। কিন্তু কেউ থাকে না বলে গ্রামে আর যাওয়া বা থাকার মত পরিবেশ ছিল না। ইদানীং পরিকল্পনা করছি, গ্রামে এক দুইদিন থাকার মত স্থাপনা নির্মাণের। আমার ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামে। গ্রাম মানে একদম গ্রাম। আমি ক্লাশ সেভেনে পড়া পর্যন্ত আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। উদার প্রকৃতিতে মুক্ত হাওয়ায় বেড়ে উঠেছি আমরা। খেলাধুলা, পুকুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতারানো, মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো, মাছ ধরা, শাপলা-শালুক তুলে খাওয়া- আহা বড় আনন্দময় ছিল সেই দিনগুলো। আমার বড় আক্ষেপ আমাদের একমাত্র সন্তান প্রসূন সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। এটা আমারই ব্যর্থতা। আমি তাকে সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছি। আমার অনেকদিনের ইচ্ছা ছেলেবেলার মত শেষ বয়সটা গ্রামে কাটানোর। পারবো কিনা জানি না, তবে মরিয়া একটা চেষ্টা করবো। আমার এই চেষ্টায় সাহস জোগাচ্ছেন সাহসী কিছু মানুষ। সাংবাদিক বন্ধু তৌহিদুর রহমান ঢাকায় অনেক বড় বড় দায়িত্ব পালন করেছেন। আরো অনেক বড় দায়িত্ব পালন করার যোগ্যতা তার ছিল। কিন্তু অনেকদিন ধরেই তিনি শ্রীমঙ্গল এলাকায় একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকেন। কবি সরকার আমিন ও সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী দম্পতি ঢাকার কাছেই মদনপুর এলাকায় ‘প্রশান্তি বাড়ি’ নামে একটা আনন্দ আশ্রম বানিয়েছেন। প্রতিদিন ঢাকায় অফিস করতে হয় বলে তাদের বেশি দূর যাওয়ার উপায় ছিল না। তবে লেখক ও রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার গ্রামে ছোট একটি বাড়ি বানিয়ে সেখানেই থাকছেন। মাঝে মাঝে তিনি ‘শহরে’ মানে ঢাকায় আসেন। নিয়মিত চাকরি করার তাগিদ না থাকলে ঢাকায় থাকার কোনো মানে নেই। মহিউদ্দিন ভাই গ্রামে বসে লেখালেখি করলেও তার বই পাঠক লুফে নেবে। তৌহিদ গ্রামে বসে কনসালটেন্সি করে পেট চালানোর মত আয় করছেন। জীবনে তারা আমার বা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো আছেন। নির্মল হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারছেন। বিশুদ্ধ জিনিস খেতে পারছেন। মহিউদ্দিন ভাই যখন তার চাষবাস, প্রকৃতি, নদীর মাছ, শেয়ালের ডাক শোনার কথা ফেসবুকে তুলে ধরেন; আমার রক্তের ভেতরেও অন্যরকম এক টান অনুভব করি। এইসব সাহসী মানুষ আমাকে আরো উস্কানি দেন, অনুপ্রাণিত করেন; একদিন নিশ্চয়ই আমিও তাদের মত গ্রামে ফিরে যেতে পারবো। এই গরমে সন্ধ্যার পর বাড়ির দখিন দিকে গাছে ঝোলানো হ্যামকে শুয়ে থাকবো, বাতাসে ভেসৈ আসবে হাস্নাহেনা আর বাতাবি লেবুর ঘ্রাণ। আহা স্বর্গ খুঁজতে বেশি দূর যেতে হয় না। শুয়ে শুয়ে আল মাহমুদ আওড়াবো-
আম্মা বলেন, পড়রে সোনা
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
তখন কেবল ভাবতে থাকি
কেমন করে উড়বো,
কেমন করে শহর ছেড়ে
সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো !
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য।‘
জীবিকার টানে আমরা শহরে ছুটে আসি বটে। কিন্তু এখানে জীবন-জীবিকা অনেক কঠিন। বাসা ভাড়া, খাওয়া খরচ, পড়াশোনা- খরচের হাজারটা খাত। গ্রামে বাসা ভাড়া দিতে হয় না। মাছ-সবজি অনেককিছুই বাড়ির পাশেই ফলানো যায়। বিকেলে চায়ের দোকানে আড্ডা ছাড়া খরচের তেমন কোনো খাত নেই। ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ আয় দিয়ে গ্রামে রাজার হালে থাকা যায়।
করোনার সময় এই নিষ্ঠুর শহরে কাজ হারিয়ে অনেক মানুষ অসহায় হয়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। করোনা গেলেও অর্থনীতি এখনও ঠিক হয়নি। মূল্যস্ফীতির প্রবল চাপে পিষ্ট মানুষ। তাই গ্রামে ফেরার যে প্রবণতা, তা ধীরে ধীরে বাড়ছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোই এই হিসাব দিয়েছে। ২০২১ সালে প্রতি হাজারে ৬ জন মানুষ গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। ২০২২ সালে এই সংখ্যাটা ছিল হাজারে প্রায় ১১ জন। আর ২০২৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে হাজারে প্রায় ১৪। এই সময়ে শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়লেও গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা কমেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ২০২২ সালে গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর হওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল প্রতি হাজারে ২৬ দশমিক ৪। আর ২০২৩ সালে তা কমে নেমে এসেছে প্রতি হাজারে ২০ জনে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই তথ্যের পাশাপাশি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট পরিচালিত এক যৌথ গবেষণায়ও কৌতূহলোদ্দীপ তথ্য রয়েছে। তাদের গবেষণা বলছে, শহরাঞ্চলে দারিদ্র বাড়ছে আর কমছে গ্রামে। ২০১৮ সালে শহরাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে ২১ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে।
আসলে প্রযুক্তির কল্যাণে এখন গ্রাম আর শহরের ব্যবধান কমে আসছে। নির্দিষ্ট চাকরির ব্যাপার না থাকলে গ্রাম আর শহরে কোনো ফারাক নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে শহরের সাথে গ্রামের দূরত্বও কমে গেছে। গোটা বাংলাদেশ এখন ৯ ঘণ্টার দূরত্ব। অনেক নাগরিক সুবিধা এখন গ্রামেও পাওয়া যায়। চাইলে চট করে ঢাকায় চলেও আসা যায়। হাইস্পিড ইন্টারনেট থাকলে পঞ্চগড়ে বসেও আপনি লাখ টাকা আয় করতে পারবেন। লেখালেখি, কনসালটেন্সির জন্য ঢাকায় থাকা আর দিনাজপুরে থাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বিনোদন তো এখন সবার হাতের মুঠোয়। নাগরিক সুযোগ-সুবিধার সাথে যদি গ্রামের উদার প্রকৃতি, নির্মল বায়ু, ভেজালমুক্ত খাবার মেলে; আর কি চাই।
গ্রামে কথা লিখতেও ভালো লাগে। একদিকে নস্টালাজিয়া, অন্যদিকে আজ যেন কবিতায় পেয়েছে আমায়। শেষ করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়ে-
‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন
মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব—
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার,
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,
পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।‘