নিজস্ব প্রতিবেদক:
দম বন্ধ করা ইমারতে ঠাসা এই শহরে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জন্য মানুষের যাওয়ার জায়গা নেই কোথাও। রাজধানীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়েনি নগর উদ্যান। যেগুলো আছে তার অবস্থাও জরাজীর্ণ। ঢাকা শহরে যে কয়টি সবুজ বলয় রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রমনা পার্ক- সোহরাওয়ার্দী উদ্যান- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে ঢাকার অন্যান্য এলাকার চেয়ে রমনা পার্ক- সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হয়। সবুজায়ন এর প্রধান কারণ। সকাল-বিকাল হাজার হাজার মানুষ এখানে হাঁটতে আসেন। আবার ইট-পাথরে ঘেরা এ নগর জীবনের দম বন্ধ হয়ে ওঠা পরিবেশ থেকে বেরিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে নগরবাসী এখানে আসেন অবসর সময় কিংবা ছুটির দিনগুলো কাটাতে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, যাতে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারকেলের চারা রোপণের মধ্য দিয়ে একটি উদ্যান তৈরির উদ্বোধন করে উদ্যানটির নামকরণ করেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। জাতির আন্দোলন সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক জাগরণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এখন নগরীর কোটি কোটি মানুষের ফুসফুস সচল রাখার গুরুদায়িত্ব পালন করছে। উদ্যানের সৌন্দর্য নষ্ট করে স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিভিন্ন স্পটে মোট সাতটি খাবারের রেস্টুরেন্ট নির্মাণকে কেন্দ্র করে বৃক্ষনিধন হয়েছে এবং অব্যাহত রয়েছে। খাবারের রেস্টুরেন্ট নির্মাণের ফলে ইকোলজিকাল পরিবেশ বিনষ্টের পাশাপাশি উদ্যানের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক ভাবগাম্ভীর্য নস্ট হচ্ছে।
এমতাবস্থায়, ৩ মে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান এর নেতৃত্বে একটি দল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কর্মযজ্ঞ সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। উদ্যানটির বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরতে আজ ৪ মে ২০২১ মঙ্গলবার পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন একটি অনলাইন আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা অনুষ্ঠানে পবার সম্পাদক ও গ্রিন ফোর্স সমন্বয়ক মেসবাহ সুমনের সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট বাংলাদেশ (আইএবি) এর সাবেক সভাপতি। প্রখ্যাত স্থপতি, স্থাপত্যের শিক্ষক ও শিল্প সমালোচক অধ্যাপক শামসুল ওয়ারেস।
আলোচক হিসেবে ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন, নগর-পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)এর সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান, পবা’র সাধারন সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আব্দুস সোবহান, স্থপতি ও আরবান ডিজাইনার, গবেষক, মোহাম্মদ জাকারিয়া ইবনে রাজ্জাক রাসেল, স্থপতি শাহিন আজিজ, লেখক, গবেষক পাভেল পার্থ, পবা’র সম্পাদক নীতি বিশ্লেষক ও আইনজীবি সৈয়দ মাহবুব আলম তাহিন, বানিপা’র সাধারণ সম্পাদক, এম এ ওয়াহেদ, পরিবেশ কর্মি শামিমা জাহান প্রমুখ।
উদ্বেগ প্রকাশ করে আলোচকবৃন্দ বলেন, একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য উদ্যানকে ঘিরে বিভিন্ন রকম পরিবেশ বিরোধী অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচারে গাছপালা কেটে ফেলায় প্রতিবেশের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ রমনা পার্ক এলাকা রাজধানীর ‘ফুসফুস’ হিসাবে চিহ্নিত। ইতিহাসের সাক্ষী সবুজের সমারোহ গাছ-গাছালির ছায়াঢাকা পাখিডাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। দেশের নতুন প্রজন্ম, পরবর্তী প্রজন্ম বংশপরম্পরায় শত শত বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দেখবে এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বকে স্মরণ করবে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত স্থানগুলো চিহ্নিত করেই ঢাকার এই খোলা ময়দানকে উন্মুক্ত রাখা সম্ভব। সবুজ প্রায় নিঃশেষিত উদ্যানটি আর যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
বক্তারা আরো বলেন, রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঢাকার টিকে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সবুজ বলয়ের একটি। এখানে প্রাচীন গাছ কেটে রেস্টেুরেন্ট ও ওয়াকওয়ে তৈরি করার নামে একে ধংস করা হচ্ছে। এখানকার গাছপালা, বন্যপ্রাণী, বাস্তুসংস্থান, প্রতিবেশ সবকিছুকে সুরক্ষিত রেখেই এর উন্নয়ন করতে হবে। সংবিধান, পরিবেশ আইন এবং মানুষের সাথে এর স্মৃতিময় সম্পর্ক সবকিছুর বিবেচনায় এরকম নৃশংস কাজ বন্ধ করা দরকার। এখানে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, নববর্ষ কতকিছুর ঐতিহাসিক স্মৃতি আছে। রেস্টুরেন্ট আর ওয়াকওয়ে কার জন্য? এখানে তো মানুষ মুক্ত অক্সিজেন নিতে আসে, সুস্থ হওয়ার জন্য শরীরচর্চা আর বিনোদনের জন্য আসে। উদ্যানের ভেতর কী ধরণের অবকাঠামো থাকবে তার একটি নীতিমালা দরকার। এটি একটি পাবলিক উদ্যান। এখানে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সমান হক আছে। এভাবে গাছ কাটা হলে গুল্ম, ফার্ণ, ছত্রাক, লাইকেন, অণুজীব, পাখি, বেজি, কাঠবিড়ালী, সাপ, বাদুর, প্রজাপতি, মৌমাছি, কেঁচোসহ নানা বন্যপ্রাণ চিরতরে তাদের বসত হারাবে। অযথা রেস্টুরেন্ট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে আইনি সহায়তা নিতে হবে।
বক্তারা আশা প্রকাশ করে বলেন, আমরা চাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানটি যান্ত্রিক ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠুক। তবে উন্নয়ন হতে হবে উদ্যানের গাছপালা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে। উদ্যানের সবুজকে ধংস করে নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বড় শহরগুলোতে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে উদ্যান ও বড় ময়দানগুলোকে পুরোপুরি সংরক্ষণ করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আমাদের গৌরবের প্রতীক স্থান। ইকো সিস্টেম বজায় রেখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে একটি সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে তা বাস্তবায়িত হোক। আলোচনা থেকে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
সুপারিশসমূহ:
ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অযথা রেস্টুরেন্ট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। নির্বিচারে উদ্যানের গাছ নিধন বন্ধ করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্প পুনর্বিন্যাস করে, গাছপালা রেখে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সকলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরিবেশ, তত্ত্বাবধান, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, দৈনন্দিন পরিচালনা বিশ্বমানের করতে হবে। রমনা গ্রিন ধরে রাখতে হবে।
জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। উন্নয়ন কমকান্ডের ফলে উদ্যানের জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক ভারসাম্য যেন নষ্ট না হয় তার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে।
উদ্যানের স্থান ও পরিবেশ সংরক্ষণ করতে একটি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিতে হবে।
উদ্যানে রেস্তোরা, ওয়াকওয়ে কিংবা এ জাতীয় উন্নয়ন কর্মকান্ডের পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে অবিলম্বে জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।
উদ্যানসহ সকল ঐতিহাসিক স্থাপনা বা এলাকার উন্নয়ননের জন্য নগর পরিকল্পক, স্থপতি, শিল্পী, ইতিহাসবিদ, উদ্যানবিদ, প্রকৌশলী, শিক্ষক, পরিবেশবিদ ও কবি-সাহিত্যিক সকল স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করতে হবে। যারা পরিকল্পনা থেকে শুরু করে উন্নয়ন কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন ও প্রয়োজনীয় মতামত দিবেন।