হোসনেয়ারা পারভীন খুকু, খুলনা থেকে ॥
ভরত রাজার দেউল দেড় হাজার বছরের পুরাকীর্তি বৌদ্ধ মন্দির। এটি খুলনা ও যশোর জেলার ডুমুরিয়া-কেশবপুর সীমান্তে ভরত ভায়না গ্রামের ছায়াঢাকা পল্লীতে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন এ স্থাপনা। প্রয়োজনীয় বিশ্রামাগার, হোটেল, আধুনিক শৌচাগার, রান্নার স্পটসহ নানা সংকট থাকা সত্ত্বেও এখানে ভ্রমণে আসেন দেশী-বিদেশী পর্যটকরা। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সদিচ্ছায় আধুনিকীকরণ করলে এটি হতে পারে বগুড়ার মহাস্থানগড় কিংবা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের মতো পর্যটন কেন্দ্র।
ভরত ভায়নায় বৌদ্ধ মন্দিরটি বর্তমানে সংস্কৃতি বিষয়ক অধিদপ্তরের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। ডুমুরিয়ার শোলগাতিয়া ব্রীজ পার হয়ে এক কিলোমিটার গেলেই ভায়না গ্রাম। গাছ গাছালীতে সবুজ ছায়াঢাকা নয়নাভিরাম দৃশ্যে ভরা পল্লী গ্রাম। পাখির কলরবে পীচ ঢালা শোলগাতিয়া ব্রীজ থেকে ১ কিলোমিটার রাস্তা পেরুলেই নজরে পড়ে বট গাছ ও ভরতের দেউল। দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে এটি দর্শনার্থীদের কাছে অতিপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সপ্তাহে মঙ্গলবার হতে শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৬টা, সোমবার দুপুর ২টা থেকে ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীরা টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে পারেন স্থাপনাটি। তবে রোববার সাপ্তাহিক ছুটি থাকে।
ভরতের দেউল বিষ্ময়কর এক প্রাচীনতম নিদর্শন বৌদ্ধ মন্দির। আনুমানিক দেড় হাজার বছরের প্রাচীন এ নিদর্শনটি দর্শনার্থীদের মনে আজও কৌতূহল জাগে। মন্দিরটি নিয়ে রয়েছে অনেক কিংবদন্তি। কেশবপুর উপজেলার গৌরীঘোনা ইউনিয়নের ভরত ভায়না গ্রামে পিঠ উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরিচিত নাম ‘ভরতের দেউল’। টিলা আকৃতির ভরতের দেউলের উচ্চতা ১২.২০ মিটার এবং পরিধি ২৬৬ মিটার। প্রবীণদের ধারণা মতে, ভরতের দেউল প্রাচীন যুগে নির্মিত হলেও ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের ফলে দেউলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯২৩ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। ২০০১ সাল পর্যন্ত কয়েক দফা খনন কাজের ফলে দেউলের আকার, মঞ্চ, মন্দির এবং প্রায় ৯৪টি কক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। চারপশে ৪টি দেওয়ালে ঘেরা ১২টি কক্ষ ছাড়া ৮২টি কক্ষ বৌদ্ধ স্তুপ আকারে নির্মিত। স্তুপের চুড়ায় ৪টি কক্ষের দুই পাশে আরও ৮টি ছোট ছোট কক্ষ রযেছে। নিদর্শনের মধ্যে আরও রয়েছে পোড়া মাটির তৈরি নারীর মুখমণ্ডল, নকশা করা ইট, মাটির ডাবর, পোড়া মাটির অলংকার এবং দেবদেবীর টেরাকোটার ভগ্নাংশ।
পল্লী গ্রামে অগোচরে থাকা প্রত্নতত্ত্বটি দেখতে আসেন খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বাঞ্চলের বার্তা সম্পাদক অমীয় কান্তি পাল। তিনি বলেন, এটি দেখে মুগ্ধ হবার মত। অদ্ভুত সুন্দর এই স্থাপনা। মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়।
ভরত ভায়না বৌদ্ধ মন্দিরটি এ অঞ্চলের আদি যুগের স্থাপনা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তবে কিছু সমস্যা নিরসন করলে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে রূপ নিতে পারে দর্শনার্থীরা মন্তব্য করেছেন।
সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলা থেকে বেড়াতে আসা দর্শনার্থী একে আজাদ বলেন, বাড়ির কাছে প্রাচীন এই পুরাকীর্তি আছে আমার ৫০ বছর জীবনে কেন দেখতে পাইনি। খুবই আফসোস। সকল স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য দর্শনীয় শিক্ষণীয় এটির মাধ্যমে মনোবিকাশ ও ভাবনার জগতকে প্রকাশের সুবর্ণ সুযোগ। এটি অভিভূত ও মুগ্ধকর বিষয়।
যশোর জেলার ঝিকরগাছা থেকে আগত আব্দুল ওহাব বলেছেন, এটি নিয়ে সরকারি বে-সরকারি পর্যায়ে আরো গবেষণার দাবি রাখি। দেখে খুব ভালো লাগলো। আঃ জব্বার আজাদী বলেন, এটি একটি অনন্য নিদর্শন। বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু দর্শনার্থী এখানে আসেন। তাছাড়া অনেক গবেষকও দর্শনের জন্য আসেন। কিন্তু এখানে দর্শনার্থীদের সেবামূলক কোন ব্যবস্থা নাই। বিশেষ করে বসার ও বিশ্রামের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। বিদেশী অতিথিরা তাদের উপযুক্ত বসার স্থান কিংবা বিশ্রাম নেয়ার ব্যবস্থা নেই। অতিদ্রুত বসার জায়গা ও বিশ্রামাগার দরকার। একজন প্রশিক্ষিত লোক দরকার যিনি এ সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে। এ বিষয়ে দর্শনার্থীদের অবগত করাবেন। আশা করি, এ সকল বিষয়ে কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবেন।
যশোর রাজ্জাক কলেজের সহকারী অধ্যাপক শাহিন জানান, চলমান সময়ে দেশের সরকারি অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত একটি দৃষ্টিনন্দন গেইট থাকা দরকার। ডাষ্টবিন, ওয়াশ রুম, টয়লেট আরও আধুনিক হতে হবে। থাকতে হবে গাড়ি পার্কিং এবং রান্নার ব্যবস্থা।
যশোর বিআরডিবির উপপরিচালক বিএম কামরুজ্জামান বলেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতার সাথে মিল রয়েছে। বাড়ির কাছে এত সুন্দর পুরাকীর্তি জানা ছিল না। প্রচার প্রচারণা প্রয়োজন। কুমিল্লা নিদর্শন, মহাস্থান গড় থেকে কোন অংশে কম নয় এ নিদর্শন।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, খুলনা, যশোর, বরিশাল, ময়মনসিংহ, ঝিনাইদহ, ঢাকা, বিদেশ থেকে পর্যটকরা এখানে বেড়াতে আসেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ১.৭৬ শতক জমি ছিল পরবর্তীতে আরও ৩.৬৫ শতক জমি নেয়া হয়েছে। এখানে হোটেল, আধুনিক বাথরূম, যাদুঘর, পার্ক, আনসার ক্যাম্প, পিকনিক স্পট, রান্নার স্থান তৈরী করা হবে। এটা মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছে। এ কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারলে ভরতের দেউল আন্তর্জাতিক মানের পর্যাটন কেন্দ্রে পরিণত হবে।