শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২৩ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে প্রশাসনে অস্বস্তি

  • আপডেট সময় সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২.০১ পিএম
  • ২১ বার পড়া হয়েছে

নিউজ ডেস্ক॥

প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা যখন অবসরে যান, তখন স্বাভাবিকভাবে নিচের পদ থেকে কাউকে পদোন্নতি দিয়ে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। কিন্তু শূন্যপদ পূরণে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ায় সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে শীর্ষ পদগুলোয় বছরের পর বছর একই ব্যক্তি আসীন থাকছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে প্রশাসনে এক ধরনের ছন্দপতন ঘটে, বিশেষ করে নিচের পদগুলোয় বিরূপ প্রভাব পড়ে। অনেক কর্মকর্তার কাজের স্পৃহাও কমে যায়।

চলতি মাস থেকে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা অবসরে যাবেন। কারও কারও চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। এসব পদে কারা পদায়ন পাবেন কিংবা কারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাবেন, তা নিয়ে প্রশাসনে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।

জনপ্রশাসনে সচিবসহ শীর্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। নতুন সচিব পদে যাদের পদোন্নতি পাওয়ার কথা, তাদের আশঙ্কা, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সুবিধা পেয়ে পুরনোদের কেউ কেউ রয়ে যাবেন। ফলে অন্যরা বঞ্চিত হবেন।

এ বিষয়ে প্রশাসনের উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, এখন অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ে পদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কর্মকর্তা আছেন। যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পর্যায়েও পদের চেয়ে অনেক বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন। সচিব পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাড়তে থাকলে এসব কর্মকর্তার শীর্ষ পদে যাওয়ার পথ সঙ্কুুচিত হয়ে যায়। এ নিয়ে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ্যে তারা মন্তব্য করতে পারেন না।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সরকারের উপসচিব আছেন ১৬৩৮ জন। যুগ্ম সচিব আছেন ৭১৭ জন। অতিরিক্ত সচিব আছেন ৪৩৯ জন। গ্রেড-১ (পদমর্যাদা) পদে আছেন ১৯ জন। সচিবের সংখ্যা ৭৬।

জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নিয়মিত চাকরি শেষ করে অবসরে যাবেন দুই জ্যেষ্ঠ সচিবসহ ১০ সচিব। পাশাপাশি এ সময়ের মধ্যে চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবসহ আরও তিন সচিবের। ফলে প্রশাসনের শীর্ষ পদ- মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিবসহ ১৩ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিবের পদ খালি হচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সিনিয়র সচিব/সচিব পদমর্যাদায় কর্মকর্তা সংখ্যা ৭৬ জন উল্লেখ আছে। তাদের মধ্যে বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত ও স্পেশাল ব্যাচের একজন করে, ১৯৮৪ ব্যাচের পাঁচজন, ১৯৮৫ ব্যাচের দুজন, ১৯৮৬ ব্যাচের ১২ জন, নবম ব্যাচের ১০ জন, দশম ব্যাচের ২৫ জন এবং একাদশ ব্যাচের ২০ জন রয়েছেন। তাদের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিবসহ ১৩ জনই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কর্মরত।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের চুক্তিভিত্তিক চাকরির মেয়াদ শেষ হবে আগামী ডিসেম্বরে। চুক্তিতে থাকা সচিবদের মধ্যে ২২ সেপ্টেম্বর মেয়াদ শেষ হচ্ছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব শহীদ উল্লা খন্দকারের। এই কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রশাসনের অন্যরা ‘ঈর্ষান্বিত’। কারণ, বর্তমান সরকারের আমলে তিনি সবচেয়ে বেশি সময়ের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। সবচেয়ে বেশি সময় ধরে একটি মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। টানা ছয় বছর তিনি মন্ত্রণালয়টিতে আছেন। তার মধ্যে পাঁচ বছরই চুক্তিভিত্তিক। মন্ত্রণালয়টির শীর্ষ পদে এতটা সময় আর কেউ ছিলেন না।

নিয়মিত সচিবদের মধ্যে সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত ফজলুল বারী, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ সচিব ড. ইয়ামিন চৌধুরী ও অক্টোবরে অবসরে যাবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব আখতার হোসেন। নভেম্বরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজম এবং ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান অমিতাভ সরকার অবসরে যাচ্ছেন।

এ ছাড়া ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাবেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মামুন আল রশিদ, বিপিএটিসির রেক্টর রামেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব এম খলিলুর রহমান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এম সাইদুল ইসলাম এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন সচিব এম মোকাম্মেল হোসেন।

এদিকে ২৭ সেপ্টেম্বর বিসিএস ত্রয়োদশ ব্যাচের কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত সচিব হওয়ার দুই বছর পূর্ণ হবে। ফলে চলতি বছরের শেষ দিকেই সচিব পদে নিয়োগ পেতে চেষ্টা করবেন এই ব্যাচের কর্মকর্তারা। আগে প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব পদে এক বছর কাজ করার পর ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। এখন তা পরিবর্তন করে অতিরিক্ত সচিব পদে দুই বছর অতিক্রম করার পর সরাসরি সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

দুটি মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করে বর্তমানে সিনিয়র সচিব হয়েছেন- এমন এক কর্মকর্তা শূন্য পদে পদায়ন প্রসঙ্গে  বলেন, আগে কোনো প্রকল্প বা বিশেষ কারণে এক বছর চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হতো। এখন সচিব পদে এক থেকে তিন বছর বা তারও বেশি সময় পর্যন্ত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। মেয়াদ শেষে কারও কারও চুক্তির মেয়াদ আরও বাড়ানো হয়। এটা পুরোটাই রাষ্ট্রের নীতিগত বিষয়।

প্রশাসনের আরেক সিনিয়র সচিব বলেন, জনপ্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পরিহার করে একটি নীতিমালা প্রণয়নে ২০১৪ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে একটি আধাসরকারি পত্র দিয়েছিলেন। যে কর্মকর্তাদের অবসরে যাওয়ার পরও সরকার কাজে লাগাতে চায়, তাদের ক্যাডারবহির্ভূত বিশেষ পদে নিয়োগ দিতে বলেছিলেন। কিন্তু সেই চিঠি আমলে নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে ২০১৪ সালে দেওয়া পে-কমিশনের সুপারিশেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ওই সময় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কিছুটা কমেছিল। পরবর্তী সময়ে আবার বেড়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে প্রশাসন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব মো. আবু আলম শহিদ খান বলেন, ‘আমরা যখন চাকরি করেছিলাম, একটি অ্যাসোসিয়েশন করতাম। আমাদের সব সময় দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ঠিক না। প্রশাসনে নানা সমস্যা তৈরি হয়। যারা পদোন্নতিপ্রত্যাশী, তারা ক্ষুব্ধ হন, ব্যথিত হন, হাতাশ হন। এ কারণে প্রশাসনে বা যে কোনো জায়গায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ঠিক নয়। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর আমলের কমিশনের সুপারিশ ছিল শুধু কারিগরি (টেকনিক্যাল), যাকে ছাড়া একেবারে চলবে না- এমন কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। ঢালাওভাবে শীর্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলে তা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কর্মস্পৃহা নষ্ট করে দেয়। আমি মনে করি যাদের পদোন্নতি দেওয়ার যোগ্য, তাদের পদোন্নতি দেওয়া উচিত।’ (সোর্স: আমাদের সময়)

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com