সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫, ০৪:৪৭ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম
যমুনা নদীর ভাঙনরোধে ক্রসবার নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব শিক্ষাঙ্গণ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে: পরিবেশ উপদেষ্টা চলনবিলের কৃষকদের স্বপ্ন এখন পানির নিচে যমুনা সেতুতে ২৪ ঘণ্টায় ৫২ হাজার গাড়ি পারাপার: টোল আদায় ৩ কোটি ৪৮ লাখ সিরাজগঞ্জে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় দুইজন নিহত, আহত তিন সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির উদ্যোগে শহীদ জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী পালিত দুই ফুট বাঁধই ভরসা, আতঙ্কে নিদ্রাহীন রাত কাটে খুলনা উপকূলবাসীর খুলনা অঞ্চলের ভরত ভায়না দেউল হতে পারে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র খুলনায় সড়ক বিভাগের বাধায় বন্ধ কেসিসির ৭ মোড়ের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ সাবেক এমপি আজিজের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

তরল দুধ খাচ্ছি নাকি ডিটারজেন্ট?

  • আপডেট সময় শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১.৪৮ পিএম

নিউজ ডেস্ক॥

ভেজাল দুধ উত্পাদন ও বাজারজাত করছেন একশ্রেণির অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী। এ দুধ সংগ্রহে কোনো গাভির প্রয়োজন পড়ে না, কষ্ট করে গড়ে তুলতে হয় না গবাদি পশুর খামারও। প্রথমে একটা ব্লেন্ডার মেশিনে হাফ কেজি খাঁটি দুধ নেওয়া হয়। তার সঙ্গে পরিমাণ মতো বিষাক্ত কেমিক্যাল জেলির সঙ্গে ডিটারজেন্ট (কাপড় কাঁচা) পাউডার, সোডা, হাফ কেজি সয়াবিন তেল, পরিমাণ মতো চিনি, স্যালাইন, লবণ, গুঁড়া দুধসহ পরিমিত মাত্রায় বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে ১৫ মিনিট ধরে ব্লেন্ডারে সব উপকরণ ভালোভাবে মিশিয়ে নেওয়া হয়। একই উপায়ে ব্লেন্ডিং হয় আরো অন্তত তিনবার। এরপর সব দুধ একটি পাতিলে ঢেলে তার সঙ্গে এক মণ পানি মিশিয়ে প্রস্তুত করা হয় খাঁটি দুধের আদলে ভেজাল দুধ। পরে ‘খাঁটি দুধ’ হিসেবে তা চালান হয়ে আসছে রাজধানীতে। দামি-দামি কোম্পানি ও সুপার শপে তা বিক্রি হয়। দীর্ঘ সময় সতেজ রাখতে এতে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন।

বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, এই ভেজাল তরল দুধ খেয়ে শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যানসারসহ বিভিন্ন মরণব্যাধি। কিডনি বা লিভারের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও নষ্ট করে দিচ্ছে। অসময়ে গর্ভপাত, পেটের বাচ্চা মৃতও হতে পারে। দীর্ঘদিন বিষাক্ত কেমিক্যাল নীরবে মানুষ হত্যা করছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। একশ্রেণির দুষ্ট লোক অধিক মুনাফার লোভে এই কাজটি করে আসছে। তারা পুরো জাতিকে হত্যা করছে। জেল-জরিমানা করে কিছুই হবে না। এদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার জন্য মেধাসম্পন্ন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এর আগে ভেজালবিরোধী অভিযান চালায় সরকার। মোবাইল কোর্টের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সারা দেশে মাঠে নেমেছিল। তবে মাঝখানে সেই অভিযানে ভাটা পড়ে। দেশে এখন খাদ্যে ভেজাল প্রচুর। এমন কোনো খাদ্য নেই যেটায় ভেজাল নেই। ভেজালের কারণে ডায়াবেটিসসহ নানান জটিল রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে শিশুরা। এছাড়া হাবাগোবা ও বিকলঙ্গ শিশু জন্ম নিচ্ছে অনেক বেশি। চিকিত্সকরা প্রাথমিকভাবে কারণ হিসেবে পেয়েছেন ভেজাল খাবার।

সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলায় উল্লিখিতভাবে দীর্ঘদিন ধরে তরল দুধ বানানো হচ্ছে। ক্ষতিকর কেমিক্যাল জেলি, বস্তা ভর্তি পাউডারসহ এর উপকরণগুলো আসছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে চোরাই পথে। তালা উপজেলার জেয়ালা গ্রামে এই ভেজাল দুধ তৈরি হয়ে আসছে। এই এলাকাটি দুগ্ধ পল্লি হিসেবে পরিচিত। এই ভেজাল কারবারিদের কারণে যারা খামারি, তারা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। গরুর খামারিরা বলেন, আমরা দুধ উত্পাদন করতে হিমশিম খাচ্ছি। অথচ ভেজালকারীরা এক লিটার দুধ দিয়ে ৫০ লিটার পর্যন্ত দুধ বানাচ্ছে। কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করে আসছে। এখানে খামারিরা টিকবে কীভাবে? ভেজাল তরল দুধের ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাছে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ আসছিল। পরে তারা খবর নিয়ে দেখে অবস্থা ভয়াবহ। ভেজালের নেপথ্যে লাঘব-বোয়ালরাও জড়িত।

গত মঙ্গলবার তালা উপজেলার জেয়ালা গ্রামে দুগ্ধ সমবায় সমিতির সভাপতি প্রশান্ত ঘোষকে ভেজাল তরল দুধসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। এই অভিযানে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছিলেন জেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুহুল কুদ্দুস। জেলা দুগ্ধ সমবায় সমিতির সভাপতি প্রশান্ত ঘোষকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। এই ভেজাল দুধ মিল্ক ভিটা, আড়ং, আকিজসহ আরো কয়েকটি দামিদামি কোম্পানির কাছে সরবরাহ করা হতো বলে ভেজাল উত্পাদনকারীরা মোবাইল কোর্টকে জানিয়েছে। ঐসব নামিদামি কোম্পানির একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী এই ভেজাল দুধ বাজারজাতের সঙ্গে জড়িত। সাতক্ষীরার মানুষ অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ভেজাল নির্মূল করতে হবে।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, দেশের ক্যানসার বৃদ্ধির মূল কারণ খাদ্যে ভেজাল। ভেজাল তরল দুধ খেলে ১০ থেকে ২০ বছর পরে পাকস্থলিতে ক্যানসারের সম্ভাবনা সর্বাধিক। আজ থেকে ২০ বছর আগেও দেশে এত ক্যানসারের রোগী ছিল না। ৩০০ বেডের ক্যানসার ইনস্টিটিউকে ৪৮০ বেডে উন্নীত করা হয়েছে। তবে প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার রোগী চিকিত্সা নিতে আসে। তাদের জায়গা দিতে পারি না। অথচ আগে শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একটি ইউনিট দিয়েই ক্যানসার রোগীদের চিকিত্সা সেবা দেওয়া হতো। তিনি বলেন, ভেজাল তরল দুধ খাওয়ার কারণে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সিদের পাকস্থলিতে ক্যানসারের সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া যে কোনো জায়গায় ক্যানসার হতে পারে। ভেজাল খাবার খাওয়ার চেয়ে কম খাওয়া অনেক বেশি ভালো। এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। জাতিকে রক্ষা করতে হলে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।

ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ভেজাল তরল দুধ খেলে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ। এছাড়া শরীরে টিস্যুগুলো নষ্ট হয়। হূদিপণ্ডে ক্ষতি হয়। হূদেরাগ হতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।  তাত্ক্ষণিক ডায়রিয়া ও বমি হতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, ভেজাল তরল দুধ খেলে তাত্ক্ষণিক ডায়রিয়া, বমিসহ পেট খারাপ হবে। এছাড়া কিডনি ও লিভার ফেইলার হতে পারে। আর দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্যানসার হবে। দ্রুত মৃত্যুও হতে পারে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক ডা. বদরুল আলম বলেন, কেমিক্যালে যে টক্সিন তা খেলে নার্ভগুলো ডেমেজ হতে পারে তাত্ক্ষণিক। নিউরোপ্যাথি হতে পারে। হাত-পা অবশ হয়ে যেতে পারে। হাবাগোবা হওয়ার আশঙ্কা বেশি। অল্প বয়সিদেরও এটা হতে পারে। অনেক অল্প বয়সিদের হাত-পা অবশ হওয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এ ধরনের ভেজাল খাবার এসব রোগের অন্যতম কারণ।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সাতক্ষীরা জেলার সহকারী পরিচালক নাজমুল আহসান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে খোঁজখবর নিয়ে অভিযান চালানো হয়েছে। বিষাক্ত কেমিক্যাল ও অন্যান্য সামগ্রী সীমান্ত দিয়ে তারা আনত। সকল কোম্পানি এখান থেকে ঐ ভেজাল দুধ নেয়। এক কেজি পাউডার দিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি ভেজাল দুধ উত্পাদন করা হয়। কেউ কেউ বলেছেন, ৫০ কেজি পর্যন্ত দুধ উত্পাদন করে। ভেজালের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।

জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান বলেন, এটা আর্টিফিশিয়াল দুধ। বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রণ করা হয়। ওখানে অভিযানে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা হয়েছে। বিষাক্ত ৭০০ কেজি জেলি জব্দ করা হয়েছে। এর আগেও জেলি জব্দ করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে ১ হাজার ১৫০ কেজি জব্দ করা হয়েছে। ভারত থেকে চোরাই পথে এসেছে এসব জেলি। জেলা দুগ্ধ সমবায় সমিতি সভাপতি প্রশান্ত ঘোষের কারখানা থেকে বস্তা ভর্তি তরল দুধের প্যাকেট বিক্রি করার সময় হাতেনাতে ধরা হয়।

সোর্স: ইত্তেফাক

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com