ডেস্ক রিপোর্ট॥
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। তিন মাসের ব্যবধানে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা বেড়ে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।
সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। ঋণ নিয়ে আলোচনার জন্য ঢাকায় এসে সংস্থাটির প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বিষয়টি জেরালোভাবে উত্থাপন করেছিলেন। ঋণ দেয়ার সম্মতি দিয়ে আইএমএফের কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনে ফিরে যেতে না যেতেই আরেক দফা বাড়ল খেলাপি ঋণ।
বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল রোববার খেলাপি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, সব মিলিয়ে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকমালিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আজ থেকে আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। এ বিষয়ে ব্যাংকমালিকরা তাকে কথা দিয়েছেন। বরং এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে, তা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হবে।’
অথচ চলতি বছরের শুরু থেকেই খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। জুন শেষে সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।
২০২০ ও ২০২১ সালজুড়ে কয়েক দফায় মহামারি করোনার কারণে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে কোনো ঋণ পরিশোধ না করে কিংবা সামান্য পরিশোধ করে খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ ছিল। এ ধরনের বিভিন্ন সুবিধার বেশির ভাগই শেষ হয়েছে গত ডিসেম্বরে। এর পরপরই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ব্যাপকভাবে।
কেবল টাকার অঙ্কে নয়, খেলাপি বেড়েছে শতকরা হিসেবেও। সেপ্টেম্বরে মোট বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশই খেলাপি ঋণ। জুন শেষে বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ খেলাপি হয়ে যায়। মার্চ শেষে ছিল ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ খেলাপি।
জুনে মোট ঋণ দেয়া হয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। মার্চে মোট ঋণ ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকার বেশি। শতকরা হিসেবে মোট ঋণের প্রায় ৮ শতাংশ। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর- ৯ মাসে বেড়েছে ৩১ হাজার ১২৩ কোটি টাকা।
২০২০ সাল থেকে দফায় দফায় খেলাপিমুক্ত থাকার সুবিধা বাড়ানো হয়। এখন অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো গেলেও একশ্রেণির ব্যবসায়ী ঋণ শোধ করছেন না। ব্যাংকগুলো নানা উপায়ে চেষ্টা করেও তাদের থেকে টাকা আদায় করতে পারছে না।
২০২১ সালে ঋণের ১৫ শতাংশ পরিশোধ হলেও তা নিয়মিত দেখানো হয়। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত কেউ এ হারে টাকা দিলেও ব্যাক ডেটেও নিয়মিত থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
চলতি বছরের ১৮ জুলাই ঋণ পুনঃতফসিলে ব্যবসায়ীদের বড় ছাড় দিয়ে নতুন নীতিমালা ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোসহ নগদ এককালীন জমা দেয়ার হার কমিয়ে ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ানো হয়।
এর ১৬ দিনের মধ্যে সংশোধনী দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া নতুন সার্কুলারে ঋণখেলাপিদের আরও ছাড় দেয়া হয়। পাশাপাশি বেশ কিছু ক্ষেত্রে কড়াকড়িও করা হয়।
সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে
সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ও বেসিক ব্যাংক- এই ছয় ব্যাংকের মোট ঋণ ৬০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। তিন মাসে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৭৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
জুনে এই ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
মার্চ শেষে এই ছয় ব্যাংকের মোট ঋণ ছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৪৮ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ২০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংক
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ১৮ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৬২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ খেলাপি হয়ে আছে।
মার্চ পর্যন্ত এসব ব্যাংকের ঋণ ছিল ৯ লাখ ৮৮ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৫৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ খেলাপি হয়ে আছে।
বিশেষায়িত তিন ব্যাংক
বিশেষায়িত কৃষি, প্রবাসী কল্যাণ ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক- এই তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। এ অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ। তিন মাসে বেড়েছে ৮৩ কোটি টাকা।
জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। মার্চে এই তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা। এ অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।
বিদেশি ৯ ব্যাংক
বিদেশি মালিকানার ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে। এসব ব্যাংকের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ।
মার্চে এই ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘অব্যাহতভাবে গ্রাহকদের সুবিধা দেয়া হলেও একটা বড় অংশের ঋণ খেলাপি থেকে যাচ্ছে এবং সেই খেলাপির পরিমাণ বাড়ছে। আইএমএফের সঙ্গে যে কথা হয়েছে, সে অনুযায়ী সরকারের এই হার আরও কমিয়ে আনতে হবে। প্রকৃতভাবে হিসাব করলে এ খেলাপি ঋণ আরও বেশি। সুতরাং যেসব সুবিধা ঋণখেলাপিদের দেয়া হয়েছে, আগামীতে এসব সুবিধা দেয়া কষ্টকর হবে।’
তিনি বলেন, ‘যারা নিয়মিত খেলাপি, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।’