চারদিকে উত্তপ্ত আলোচনার শেষ নেই। একের পর এক ইস্যু জন্ম নিচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। তা নিয়ে চলছে দেদার আলোচনা। যেমন এখন ডা. সাবরিনা, তিশা মুশতাককে নিয়ে দেশ তোলপাড়। বলছি না ইস্যুগুলো ছোট বা এসব ইস্যু করে আলোচনা নিরর্থক। কিন্তু আর কতদিন! যেসব ইস্যু আপামর জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, মানুষ যে ইস্যুগুলোর প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী সে ইস্যু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে কম। কথা হচ্ছে কম। ডেঙ্গুতে দেশ সয়লাব হলো, কত মানুষ যে মরলো তার ঠিক নেই। হাসপাতালে মারাত্মক অপচিকিৎসা, ডাক্তারদের প্রতি অনাস্থা চরমে পৌঁছেছে, সিটি কর্পোরেশনের নিষ্ক্রিয়তায় জনজীবন বিপন্ন।
মশায় জনজীবন অতিষ্ঠ, পুরোটা বর্ষাকাল রাস্তাগুলো ডুবে থাকে পানিতে, এমনকি পানি ঘরেও ঢুকে যায়। রাস্তায় জমা পানিতে মশা-মাছি জন্ম নেয়, নিষ্কাশন হয় না। বন গাছপালা পরিষ্কার হয় না। মানুষ আট ঘণ্টা দশ ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকে। পরিচ্ছন্নতার নামে বৃক্ষ নিধন চলছে। প্রকৃতি গাছ শূন্য করে ফেলা হচ্ছে। এসব নিয়ে লোকে ভয়ে ফিসফিস করে কথা বলে সেই যুদ্ধদিনে লুকিয়ে চরমপত্র শোনার মতো।
বর্ষাকাল চলে গেছে খানিকটা স্বস্তি। কিন্তু সামনে তো আবারও বর্ষা আসবে! নিশ্চিত একই অবস্থা চলতে থাকবে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা চলছে দ্রব্যমূল্য আর চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে। লাগামহীনভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। করোনার কারণে এমনিতেই বিশ্বব্যাপী ধস নেমেছে। দেশের অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছে। স্বল্পপুঁজির লোকজনের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। শহরে চলতে না পেরে অসংখ্য মানুষ গ্রামে
পাড়ি দিয়েছে। এর মধ্যে বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। বাসাভাড়া, শিক্ষা খরচ, চিকিৎসা খরচ, পরিবহন খরচ, পোশাকের খরচ, জ্বালানি খরচ বেড়েছে। অথচ আয় সে অনুযায়ী বাড়েনি।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে নিম্নআয়ের লোকদের আয় যা বেড়েছে তার তুলনায় খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। তাই প্রতিটি পরিবারকে খরচ কমাতে হয়েছে। পণ্য কিনতে হচ্ছে কম। ফলে বাচ্চারা পুষ্টি পাচ্ছে কম। খাবার যদি কম পড়ে তাহলে তাদের স্বাস্থ্যই বা টিকবে কী করে. মেধাই বা হবে কী করে? খাবারই তো পুষ্টি।
অদ্ভুত ব্যাপার, একবার যে জিনিসের দাম বাড়ে তা আর কমে না। আগে যে পণ্য ৪০০০ টাকায় কেনা যেত এখন তা কিনতে লাগে নূন্যতম ৬০০০ টাকা। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য যে চাল সে চালের দাম বেড়েছে। বেড়েছে লবণের দাম। নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়ের সিংহভাগ যায় চালের পেছনে। চালের সঙ্গে দুটো আলু মিশিয়ে তারা খায়। আলুর দাম বেড়েছে। চালের খরচ উচ্চবিত্তের চেয়ে নিম্নবিত্তের বেশি। উচ্চবিত্তরা নানান ধরনের খাবার খেয়ে থাকে কিন্তু নিম্নবিত্তের খাবার বলতে দুবেলা দুমুঠো ভাত। সেই চালের দাম আকাশ ছোঁয়া। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বিশ্ববাজারে দাম বাড়া, যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের সংকটের কথা বলা হচ্ছে। দেশে প্রচণ্ড ডলার ক্রাইসিস চলছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। তাই বিশ্ববাজারে কোন কোন পণ্যের দাম কমলেও আমদানিকারকরা পণ্যের দাম কমাচ্ছে না। তারা ডলার কিনছে উচ্চমূল্যে আর সেই বোঝাটা চাপিযে দিচ্ছে দরিদ্র মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের কাঁধে।
এই অবস্থায় অনেক পরিবারকে বড় বাসা ছেড়ে ছোটবাসায় আসতে হয়েছে। অনেকে সন্তানদের ভালো স্কুল থেকে কম বেতনের স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। অনেকে কোনোক্রমে খাবারের পয়সা জোগাড় করছেন। চিকিৎসা ব্যয় জোগাড় করতে পারছেন না।
যে বাড়িতে শিশু বৃদ্ধ অন্তঃসত্তা নারী কিংবা অসুস্থ মানুষ আছেন তাদের ডিম দুধের চাহিদা তো থাকবেই। ডিমের দাম ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ছয়জন মানুষের একটা সংসারে একটা করে ডিম খেলে একডজন ডিমে দুদিন চলে। তাহলে মাসে ডিমের খরচই ৪/৫ হাজার টাকা। দিনে এক টুকরো মাছ খেলে মাসে পনের হাজার টাকা। সঙ্গে তেল মশলা সবজির কথা তো বললামই না। তাহলে যে লোকটি মাসে বেতনই পান পনের হাজার টাকা তিনি বাসাভাড়া দেবেন কী দিয়ে, খাবেন কী, যাতায়াত করবেন কীভাবে, রোগ শোক মোকাবিলা করবেন কীভাবে। মাঝে মাঝেই কোন কোন পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। কখনও পেঁযাজ কখনও কাঁচা মরিচের ঝালে আমরা অতিষ্ঠ হই।
অবস্থা বিবেচনা করে, টিসিবির মাধ্যমে পুরো শহরের ৩০টি পয়েন্টে ট্রাকে আলু তেল ডাল পেঁয়াজ দেওয়া হচ্ছে। দুই কেজি মসুর ডাল, দুই লিটার সয়াবিন, পেঁয়াজ আলুসহ মোট মূল্য ৪৮০ টাকা পড়ে, যা বাজার মূল্যের অর্ধেক। প্রতিদিন ৭২ টন খাদ্য দেওয়া হচ্ছে। পূর্বে ১০ লাখ মানুষ এর আওতায় থাকলেও সম্প্রতি আরো দুই লাখ যোগ হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ এই দ্রব্যাদি কিনছে। অনেকে দিনভর দাঁড়িয়ে থাকার পরও পাচ্ছে না। লাইনে কোলে শিশু নিয়ে নারী থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের দেখা যাচ্ছে। শারীরিক সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও তারা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকছেন। তারপরও কেউ কেউ পাচ্ছেন না। কারণ পণ্যের পরিমাণ ভোক্তার তুলনায় সীমিত। ২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে টিসিবি এক কোটি পরিবারকে কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে ভোগ্যপণ্য বিতরণ করছে।
সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু সহযোগিতার অভাবে প্রত্যাশিত সাফল্য আসছে না। কনজুমার্স সাপ্লাই নামে একটা প্রতিষ্ঠান আছে। তারা কী কাজ করে, কীভাবে করে জানা নেই। তাদের কোনো কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়।
বয়ঃবৃদ্ধ ও শারীরিকভাবে অক্ষমদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে আনা প্রয়োজন বলে মনে করি। টিসিবি দরিদ্র মানুষের জন্য যে কার্যক্রম হাতে নিয়েছে তা প্রশংসনীয়। তবে কম দামে পণ্য দিয়ে কখনও সমস্যার সমাধান হবে না। একটা স্বাধীন দেশে ৫২ বছর পার করার পর এ অবস্থা কেন হবে! কেন বাজার নিয়ন্ত্রণ থাকবে না! কিছুদিন আগে একজন মন্ত্রী বলেছিলেন, সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না। আমরা সিন্ডিকেট চাই না। তারপরও যদি কখনও সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে সেটা ভাঙা যাবে না কেন? মনিটরিং-এর দিকটা বড় দুর্বল এদেশে। নেই কোন জবাবদিহিতা। মাঝে মাঝে মোবাইল কোর্ট করে কিছু জরিমানা করা হয়। জরিমানার টাকা দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই তারা দ্বিগুণ টাকা তুলে নেয়। কাজেই এটা আর যাই হোক শাস্তি নয়।
প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। বাচ্চাদের খাবার যারা মজুত করে, যারা কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের দাম বাড়ায় তারা এক অর্থে হত্যাকারী। এইসব মজুতদারি কালোবাজারি বন্ধ করা দরকার। দেশে আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। এদের অনেকের সঙ্গেই ক্ষমতাসিনদের যোগাযোগ থাকায় ভুক্তিভোগীরা ভয় পেয়ে যায়। কোন অভিযোগ করে না। কিন্তু অধিকার আদায়ে সবাইকে তৎপর হতে হবে।
দেশের অগণিত বেকার চাকরি পাচ্ছে না। বড় বড় কিছু আমদানিকারক গোটা আমদানি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। একসময় দেশে ছোট ছোট বেশ কিছু আমদানিকারক ছিল। তারা এলসি খুলে পণ্য আমদানি করতো। নানা কায়দায় তাদের আমদানি কার্যক্রম থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা সময়মতো ব্যাংক ঋণ শোধ করে না। ব্যাংক ঋণ বড় বড় আমদানিকারদের কয়জন ঠিক মতো পরিশোধ করে! মাঝে মাঝেই তো খেলাপির তালিকায় বড় বড় ব্যবসায়ী শিল্পপতির নাম দেখি। আমি মনে করি, কিছু সামান্য সবসময় থাকবে। এই বেকার ছেলে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে।
ব্যাংক থেকে সহজশর্তে ঋণের ব্যবস্থা করলে দেশের ব্যবসা বাণিজ্য গুটিকয় মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হবে না। প্রতিযোগিতা হবে। নতুন উদ্যোক্তাদের হাতে টাকা আসবে, অর্থের ফ্লো বাড়বে, মুদ্রাস্ফীতি কমবে। জিনিসের দাম কমবে। আমাদের দেশ খাদ্যপণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও যথাযথ স্টোরেজ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করতে হয়। যা খুবই দুঃখের। স্টোরেজ ব্যবস্থা উন্নত করতে পারলে এ সমস্যার সমাধান হবে। বাড়তি উৎপাদিত খাদ্যশস্য স্টোরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
আস্তে আস্তে দেশের সব গ্রামে এই ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। উদ্বৃত্ত খাদ্য ক্রাইসিসের সময় ব্যবহার করা হবে। স্টোরেজ খালি হবে, নতুন শস্য উঠবে। এতে একটা বাড়তি সুবিধা আছে। তা হচ্ছে কৃষকরা সরাসরি স্টোরেজে জিনিসপত্র বিক্রি করবে। তারা ন্যায্যমূল্য পাবে। ফড়িয়া দালাল বা মধ্যস্তত্ত্বভোগীর কবলে পড়ে বঞ্চিত হবে না তারা। এরপর বাজারজাতকরণের উন্নত ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। যোদ্ধা আমরা। আমাদের দৃশ্যমান অনেক উন্নতি হয়েছে এটা যেমন সত্য, পাশাপাশি এটাও সত্য যে দ্রব্যমূল্য পাগল ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছে। পানি বিদ্যুৎ গ্যাস জ্বালানির দাম বাড়ছে হু হু করে। দেশে মহামারি আসে আসবে, হতাশা আসবে, যুদ্ধ হবে, আসবে নানান বিপর্যয়। তাতে মানবজাতি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে সেটাও ঠিক। কিন্তু সেই ঝুঁকি সামলে ওঠার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। পিছিয়ে পড়া মানুষ, নিম্নমধ্যবিত্ত, প্রান্তিক আর তৃণমূলের মানুষ যেন ঝরে না যায় সেদিকে মমতার সঙ্গে নজরদারি করতে হবে। হয় তাদের তিন বেলা খাবারের সংস্থান করতে হবে, চিকিৎসা ও অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে অথবা থামাতে হবে দ্রব্যমূল্যের পাগল ঘোড়া। আর সে জন্য কতিপয় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। মনে রাখতে হবে শুধু ধনী আর কোটিপতি দিয়ে দেশ চলে না। দেশ চলে সাধারণ মানুষের শ্রমে, ঘামে। দেশ চালায় ঐ প্রান্তিক মানুষেরাই যারা কারখানায় ধুঁকে ধুঁকে চাকা ঘোরায়।