ডেস্ক রিপোর্ট॥
দেশে ডলার সংকট বিরাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। এর প্রভাব পড়েছে পুরো অর্থনীতিতে। বিশেষ করে পণ্য আমদানিতে ডলার সংকটের প্রভাব ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাড়িয়েছে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ব্যয়। অনেক ব্যাংক নতুন করে এলসি খুলতেও পারছে না। এমন পরিস্থিতির মধ্যে সংসদ নির্বাচন ঘিরেও দেশে এক ধরনের অনিশ্চয়তার দোলাচল ছিল। তবে সব শঙ্কা কাটিয়ে বড় ধরনের ঝামেলা ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্বাচন।
নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও সুবাতাস বয়ে যায় দেশের আবাসন খাতে। বেশ কম ছিল নির্মাণসামগ্রীর দাম। নির্মাণের মূল উপকরণ রডের দাম প্রতি টনে আট থেকে ১০ হাজার টাকা কমে যায়, যা রেকর্ড লাখ টাকা ছাড়িয়েছিল। কমে আসে ইট, বালু ও পাথরের দামও। যদিও নির্মাণখাতের এই সুসময় বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। নির্বাচন যেতে না যেতে উল্টে গেছে চিত্র। আবারও বাড়তে শুরু করেছে নির্মাণ উপকরণের দাম।
আবাসন খাতের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সূত্র জানায়, মাত্র আড়াই বছরের ব্যবধানে রডের দাম প্রতি টনে ৩৫ হাজার টাকা বেড়েছে। ২০২০ সালে এক টন রড কিনতে খরচ পড়তো ৬৪ হাজার টাকা, ২০২১ সালে সেটা ৭০ হাজার টাকা হয়। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে হয় ৯৪ হাজার টাকা। ২০২৩ সালে রেকর্ড সৃষ্টি করে প্রতি টন এক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। দাম বেড়ে যায় সিমেন্ট, বালু, পাথর, ইট, গ্রিল ও রেলিংয়ের, বেড়ে যায় লেবার খরচও।
তবে ২০২৩ সালের শেষদিকে অর্থাৎ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রড, বালু ও ইটের দাম কমে যায়। লাখ টাকার রডের দাম চলে আসে ৯০ হাজার টাকায়। অনেক কোম্পানি এ সুযোগে নতুন নতুন প্রকল্পের জন্য রড, বালু ও ইট কেনা শুরু করে। আবাসন ব্যবসায়ীদের মনেও স্বস্তি বয়ে
যায়। ধারণা করা হচ্ছিল এর ফলে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের দাম কিছুটা কমে আসবে। চলমান প্রকল্পের কাজও দ্রুত শেষ হবে। যদিও সেসব হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায় নির্বাচনের পরপরই। হঠাৎ দাম বেড়ে যায় রডের। এর পরপরই দাম বাড়তে শুরু করে বালু, ইট ও পাথরের।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার খুচরা বিক্রেতারা জানান, কোম্পানি ও রডের মানভেদে দাম বেড়েছে চার থেকে আট হাজার টাকা। নির্বাচনের আগে যে রড প্রতি টন ৮৫ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছিল, সেটি এখন ৯০ হাজার টাকা হয়েছে। ৯০ হাজার টাকার প্রতি টন রড এখন ৯৫ থেকে ৯৬ হাজার টাকা হয়েছে। আর ৯৪ হাজার টাকার রড এখন আবারও লাখ টাকা বা তার কাছাকাছি হয়েছে।
নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কায় নিজ বাড়ির কাজ বন্ধ রেখেছিলেন রাজধানীর বাসাবোর বাসিন্দা আব্দুর রশিদ। বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পর হঠাৎ করেই রড-বালু-ইটের দাম বেড়ে গেছে। লেবার খরচও বেড়েছে কিছুটা। এতে বাড়তি টাকার জোগান দিতে হচ্ছে ঋণ করে। এভাবে হঠাৎ হঠাৎ দর ওঠা-নামা করার কারণে শঙ্কা তৈরি হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হন বাড়ি নির্মাণকারী। বাধ্য হন ফ্ল্যাটের দাম বাড়াতে হয়, যার প্রভাব পড়ে সাধারণের ওপরে।’
হঠাৎ রডের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী শফিক বলেন, ডলার সংকটের কারণে রডের কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। আবার লোহিত সাগরের সমস্যার কারণে পরিবহন খরচও বেশি। এ কারণে এখন দাম বেড়েছে।
নির্বাচনের আগে দাম কমার বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে এক ধরনের অশ্চিয়তা কাজ করছিল অনেকের মধ্যে। নতুন নতুন প্রকল্প ছিল না। সরকারি প্রকল্পও নতুন করে আসেনি। নির্বাচনের আগে ক্রেতা সংকটের কারণেই দাম কমেছিল। এখন চাহিদা বেড়েছে, সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
খুচরা বিক্রেতা আমিনুল বলেন, দুই মাস আগেও রডের দাম কম ছিল। এখন বেড়েছে। কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সময়ে নানান কারণ দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। এখন গ্যাস সংকটের কথা বলে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা। মূলত কাজের সিজন শুরু হয় নভেম্বর থেকে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পুরোদমে চলে কাজ। এ সুযোগে রডের দাম বাড়ানো হয়েছে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, সিমেন্টের দামও নির্বাচনের আগে ব্র্যান্ডভেদে বস্তাপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা কমেছিল। নির্বাচনের পরপরই তা বেড়ে এখন ৫০০ থেকে ৫৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সিমেন্টের মূল্যবৃদ্ধির পেছনেও কাঁচামাল আমদানি সংকটকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।
রড-সিমেন্টের মতোই বালু, পাথর, গ্রিল, রেলিং ও লেবার খরচের দামেরও পার্থক্য দেখা গেছে নির্বাচনের আগে-পরে। বিক্রেতারা বলছেন, নির্বাচনের পরপরই ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে বর্তমানে প্রতি ফুট এলসি পাথর ২১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে পাইলিংয়ের পাথর বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকা পর্যন্ত। ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে লালবালু প্রতি সিএফটি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেড়ে সাদাবালু বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকা, সাদা লোকাল বালু ১৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভরাট বালুর দামও বেড়েছে। প্রায় দুই টাকা দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকা সিএফটি।
তবে ইটের দাম বাড়ার পেছনে বৈরী আবহাওয়াকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, বৈরী আবহাওয়ার কারণে ইট শুকানোয় সমস্যা তৈরি হয়েছে। অনেক এলাকায় রোদের দেখা নেই প্রায় দেড় থেকে দুই সপ্তাহ। এতে ইট শুকাতে না পারায় অর্ধেকে নেমেছে উৎপাদন। যার প্রভাব পড়েছে দামে। এখন এক নম্বর প্রতি হাজার ইট বিক্রি হচ্ছে ১৩ হাজার টাকায়, মাস খানেক আগেও যেটা ১১ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। দুই নম্বর (মানভেদে) ইট ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা। দাম বেড়েছে খোয়ার। প্রতি সিএফটি খোয়া বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা, আর পুরোনো ইটের খোয়া বিক্রি হচ্ছে ৬৬ টাকায়।
এ বিষয়ে আল্লাহর দান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম বলেন, সাধারণত নির্মাণের সিজন শুরু হয় নভেম্বরে। এসময়ে নির্মাণ উপকরণের দাম কিছুটা বেড়ে যায়। তাছাড়া মূল উপকরণ রডের দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে অন্যগুলোতে। তবে ইটের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলা যায়। কারণ অন্য উপকরণের দাম যেভাবে বেড়েছে সেভাবে ইটের দাম বাড়েনি। এখন সারাদেশে কুয়াশা পড়ছে, বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি। এ কারণে ইট শুকাচ্ছে না, উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। এতে দাম কিছুটা বেড়েছে।
এ বিষয়ে আবাসন ব্যবসায়ী ও রিহ্যাবের সাবেক সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভুইয়া বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতির পর ডলার সংকট দেখা দেয় দেশে। অনেক ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না। রডের কাঁচামালের দামও বেড়েছে। এতে রডের দাম বাড়তি হয়েছে, সঙ্গে অন্য উপকরণের দামও বেড়েছে। এতে প্রভাব পড়েছে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টে। দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের আবাসনের স্বপ্ন।