নিউজ ডেস্ক॥
তুলা ব্যবহারকারী হিসেবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হলেও উৎপাদনকারী হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৪৫০টি স্পিনিং মিলের বার্ষিক আঁশতুলার চাহিদা প্রায় ৭৫-৮০ লাখ বেল (১ বেল=১৮২ কেজি) হলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮৬ বেল। অর্থাৎ ৩ কোটি ২০ লাখ ৮৪ হাজার ৫২ কেজি, যা দেশের মোট চাহিদার মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ। ফলে তুলার চাহিদা মেটাতে শিল্পকারখানায় স্থানীয় পর্যায়েও পরিত্যক্ত কাপড় থেকে প্রস্তুত হচ্ছে তুলা, যা স্থানীয় বাজারে চাহিদা পূরণ করছে।
তেমনি একটি কারখানা মেসার্স ইদ্রিস কটন ইন্ডাস্ট্রিজ। হবিগঞ্জ ধুলিয়াখালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগরীতে ২০০৮ সাল থেকে পরিত্যক্ত কাপড় থেকে তুলা প্রস্তুত করছে প্রতিষ্ঠানটি। গার্মেন্ট’র পরিত্যক্ত কাপড় থেকে কারখানাটিতে তুলা প্রস্তুত করা হয়। প্রতি মাসে কারখানাটিতে ৬ থেকে ৭ হাজার কেজি পরিত্যক্ত কাপড় তুলা উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে আনা হয়। এতে খরচ হয় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। পরিত্যক্ত কাপড়গুলো থেকে ময়লা দূর করেন শ্রমিকরা। পরে সেটি দেওয়া হয় মেশিনে।
শ্রমিকরা তিন থেকে চারটি মেশিনে পর্যায়ক্রমে কাপড়গুলো একপাশে হাতে চেপে মেশিনে ঢুকিয়ে দেন, অপর পাশ দিয়ে তুলা হয়ে বের হয় পরিত্যক্ত কাপড়গুলো। যত বেশি পরিমাণে কাপড় মেশিনে দেওয়া হয়, তুলা তত ভালো হয়। সেই তুলা বস্তাবন্দি করে রাখা হয় গুদামে। পরে সেই তুলা বিক্রি হয় স্থানীয় দোকান বা বাজারে।
মেসার্স ইদ্রিস কটন ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে জানা যায়, প্রতি মাসে ৬ থেকে ৭ হাজার কেজির এক গাড়ি যে পরিত্যক্ত কাপড় আনা হয়, সেখান থেকে তুলা উৎপাদন হয় ৫ হাজার কেজি। এক লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের এই এক গাড়ি কাপড় থেকে তুলা উৎপাদন করে বিক্রি করা হয় প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। স্বাভাবিক সময়ে এক গাড়ি পরিত্যক্ত কাপড় থেকেই তুলা উৎপাদন করা হয়। তবে শীত মৌসুমে তুলার চাহিদা কিছুটা বেশি থাকে। এ কারণে শীতের আগে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে কারখানাটিতে দুই গাড়ি পরিত্যক্ত কাপড়ের প্রয়োজন হয়। সেখান থেকে তুলা উৎপাদন করে স্থানীয় দোকানিদের চাহিদা পূরণ করা হয়।
এক যুগ ধরে পরিত্যক্ত কাপড় থেকে তুলা উৎপাদন করছে ইদ্রিস কটন ইন্ডাস্ট্রিজ। স্থানীয় চাহিদা মেটাতে তুলা উৎপাদন করছে কারখানাটি। স্থানীয় দোকানিরা শীত আসার আগেই লেপ-তোশক তৈরির জন্য কারখানা থেকে তুলা কিনে নিয়ে যান। আগে দোকানিদের চাহিদা বেশি ছিল, ফলে কারখানাটিতে তুলা উৎপাদনও বেশি হতো। তবে এখন কিছুটা কমেছে।
চাহিদা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বড় বড় কোম্পানিগুলোর তুলা উৎপাদন ও পণ্য উৎপাদনকে দায়ী করছেন কারখানাটির ব্যবস্থাপক আবুল কাশেম।
তিনি বলেন, যখন অর্ডার পাওয়া যায় তখন উৎপাদন বেশি হয়। কিন্তু এখন চাহিদা অনেক কম। শীতের আগে একটু চাপ বেশি থাকে। তাই দুই গাড়ি পরিত্যক্ত কাপড় লাগে। লেপ-তোশকের দোকানিরা এই তুলা কিনে নেন। আগে দোকানিদের যে চাহিদা ছিল, এখন সে তুলনায় কম। বড় বড় কোম্পানিগুলো এখন তুলা উৎপাদন করছে এবং তুলা ব্যবহৃত পণ্য বাজারে বিক্রি করছে। ফলে স্থানীয় কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমেছে।
কারখানাটিতে পরিত্যক্ত কাপড় বাছাই থেকে শুরু করে তুলা উৎপাদন ও বিক্রি পর্যন্ত বেশকিছু নারী ও পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। তিন থেকে আট হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন তারা। সেখানে কাজ করে পুরো পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করেন কেউ কেউ।
কারখানাটিতে পরিত্যক্ত কাপড় বাছাইয়ের কাজ করেন শাহানা আক্তার। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। তিন বছর ধরে তুলা উৎপাদনের এই কারখানাটিতে কাজ করছেন তিনি। শুরুতে তিন হাজার ৩০০ টাকা বেতনে চাকরি করলেও এখন তিন হাজার ৮০০ টাকা পান। স্বামীর আয়ের সঙ্গে নিজের আয় দিয়ে ছেলেমেয়ে, স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে কোনোমতে সংসার চালান।
রায়হানা খাতুন নামের অপর এক নারী দুই বছর ধরে চাকরি করেন কারখানাটিতে। স্বামীর অসুস্থ হওয়ায় কাজ করতে পারেন না। রায়হানা খাতুনই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। ইদ্রিস কটন ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে পাওয়া বেতনে একমাত্র ছেলে ও অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন এই নারী।
পাঁচ মাস আগে স্ট্রোক করে মারা যান কারখানাটির মেশিন অপারেটর নাজমা বেগমের স্বামী জিতু মিয়া। নয় বছর বয়সী একমাত্র মেয়েকে নিয়ে এখন তার সংসার চলে কারখানা থেকে পাওয়া চার হাজার ৮০০ টাকা বেতনে।
শ্রমিকদের বেতনের পাশাপাশি ইদ্রিস কটন ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতি মাসের আয়ের বেশিরভাগই মানবকল্যাণে ব্যয় হয় বলে জানান ব্যবস্থাপক আবুল কাশেম।
তিনি বলেন, কারখানার মালিক দেশে থাকেন না। তিনি মূলত কিছু মানুষের কর্মসংস্থান এবং মানুষের সেবার উদ্দেশ্যে কারখানাটি চালু রেখেছেন। এখানে প্রতি মাসে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা আয় হয়। এই টাকা মানব কল্যাণে, মসজিদ-মাদরাসায় দান, অসহায়দের বিয়ে-সাদি, অসুস্থ ব্যক্তিদের সহযোগিতা ও ত্রাণ দেওয়ার কাজে ব্যয় হয়। কারখানার আয় থেকে সাম্প্রতিক বন্যায় অসহায় মানুষকে খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
১৯৮৬ সালে জমি বরাদ্দের কাজ শুরু হলেও ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে হবিগঞ্জ ধুলিয়াখাল বিসিক শিল্প নগরীতে উৎপাদন শুরু হয়। ১৫ একর জমিও ওপর স্থাপিত এই শিল্প নগরীতে প্লট বরাদ্দ রয়েছে ৬৯টি। এই শিল্প নগরীতে ৬৫টি শিল্প প্লটে ইদ্রিস কটন ইন্ডাস্ট্রিজের মতো ৬০টি শিল্প ইউনিট গড়ে উঠেছে। যার অধিকাংশ পণ্যই স্থানীয় চাহিদার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে।