এফবিডি ডেস্ক॥
বিমাপ্রতিষ্ঠান প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বাস্তবে সম্পদ আছে ৩০০ কোটি টাকার। তবে গ্রাহকের বিমা দাবি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা, যা শোধ করতে পারছে না কোম্পানিটি। এই পরিস্থিতিতে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) ওই কোম্পানিটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকেছিল গতকাল সোমবার। বৈঠক শেষে কোম্পানিটিকে গ্রাহকদের পাওনা টাকা পরিশোধে পরিকল্পনা প্রণয়নে এক মাসের সময় বেঁধে দিয়েছে আইডিআরএ।
প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির একাধিক উদ্যোক্তা-পরিচালকের বিরুদ্ধে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিপুল ঋণ দিয়ে তা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ খালেকের বিরুদ্ধে কোম্পানিটি থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। অর্থ আত্মসাৎ-সংক্রান্ত একটি মামলায় এম এ খালেক গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। দুর্নীতির অন্য একটি মামলায় তিনি এখনো কারাগারে আছেন।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী গতকাল প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চেয়ারম্যান ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠক সূত্র বলেছে, বৈঠকে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকদের বিমা দাবি পরিশোধ করতে পারছেন না। এরপর আইডিআরএ গ্রাহকের বিমা দাবি পরিশোধে পরিকল্পনা প্রণয়নে এক মাস সময় দেয়। এক মাস পর কোম্পানিটি নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সেক্রেটারি আবুল হাসনাত মোহাম্মদ শামিম বলেন, ‘এখানে (প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স) একটা ডিজাস্টার (বিপর্যয়) হয়েছে, আপনারা সবাই জানেন। এর জন্য আসলে এককভাবে কাউকে দায়ী করে লাভ নেই। মালিকপক্ষ যারা ছিলেন, তারা উড়ে গেছেন। এখন যারা আছেন, তারা হাতে পাওয়ার পর বিপদে পড়ার মতো অবস্থায় পড়েছেন। আইডিআরএ চাইছে, আমরা যেন জনগণের টাকা ভালোভাবে ফেরত দিতে পারি। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছে বর্তমানে ৮০৯ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। আইডিআরএর একাধিক সূত্র বলেছে, ওই ৮০৯ কোটি টাকার সম্পদের মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ রয়েছে বাস্তবে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ২৪০ কোটি টাকা। বাকি সম্পদ কেবলই কাগজে-কলমে। এদিকে কোম্পানিটির কাছে গ্রাহকের বিমা দাবি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। এই বিমা দাবি আগামী ৫ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির একাধিক উদ্যোক্তা-পরিচালক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিয়ে তা আত্মসাৎ করেছেন। ব্যাংকে রাখা কোম্পানিটির স্থায়ী আমানত বন্ধক রেখে পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট একাধিক কোম্পানিকে বেআইনিভাবে ঋণ দেয়া হয়েছে। এসব ঋণ আজ পর্যন্ত পরিশোধ হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম এ খালেক। তার বিরুদ্ধেও প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী আমানত থেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এম এ খালেকের নিজের ও নিকটাত্মীয়দের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিমা কোম্পানিটির কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেননি।
এম এ খালেক যে প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তা ছিলেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইম ব্যাংক, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, প্রাইম ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, পিএফআই সিকিউরিটিজ, প্রাইম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম ইসলামী সিকিউরিটিজ, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ডস। বর্তমানে কোনো প্রতিষ্ঠানেরই কোনো পদে নেই তিনি। কোনো প্রতিষ্ঠান ছেড়েছেন তিনি নিজে থেকে, কোনোটায় চাপে পড়ে সরতে বাধ্য হয়েছেন।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে এম এ খালেকের টাকা সরিয়ে নেয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১০ সাল থেকে এম এ খালেক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বের করে নেয়া শুরু করেন। এরপর ৮ বছরে হাতিয়ে নিয়েছেন ১ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রাইম ফাইন্যান্স সিকিউরিটিজ থেকে ৩০৫ কোটি টাকা ও ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ৩৭৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া প্রাইম ইসলামী সিকিউরিটিজের ২০ কোটি, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ২০০ কোটি, পিএফআই প্রপার্টিজের ১৫০ কোটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির ১৬৭ কোটি, ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ডসের ৫০ কোটি ও পিএফআই ক্যাপিটালের ১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা। এর বাইরে ম্যাকসন্স বাংলাদেশ, ম্যাকসন্স বে লিমিটেড, গ্যাটকো, গ্যাটকো এগ্রো ভিশন, গ্যাটকো টেলিকমিউনিকেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামেও প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন এম এ খালেক। বেসরকারি খাতের আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের এসব ঋণ ইতিমধ্যে খেলাপি হয়েছে।
আইডিআরএ ২০২০-২১ সালে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে একটি নিরীক্ষা পরিচালনা করে। সেই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির তৎকালীন পর্ষদ অর্থ আত্মসাতে এম এ খালেককে সহায়তা দিয়েছে।
প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আপেল মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ ব্যাপারে আইডিআরএর সদ্য সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শাকিল আখতারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তিনি আর আইডিআরএতে নেই। তাকে বদলি করা হয়েছে। কাজেই এ বিষয়ে তার কথা বলার এখতিয়ার নেই।
এ বিষয়ে জানতে এম এ খালেকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।