শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০২ পূর্বাহ্ন

বগুড়া পুলিশ লাইনে ‘আয়নাঘর’

  • আপডেট সময় বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫, ৮.৩৮ পিএম
  • ১১ বার পড়া হয়েছে
ছবি: সংগৃহীত


স্টাফ রিপোর্টার॥



শারীরিক, মানসিক নির্যাতন শেষে দেওয়া হতো ভুয়া জঙ্গি মামলায়। সাদা পোশাকে মানুষকে রাতের আঁধারে তুলে এনে বন্দিশালায় আটকে রাখতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নির্যাতনের এমন অনেক নির্মম চিত্র উঠে এসেছে ভাগ্যহত বন্দিদের মুখে, যারা শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর জীবিত ফিরে এসেছেন। তাদের মতে, এটা ছিল এক ধরনের ‘আয়নাঘর’, যেখানে মানুষ শুধু হারিয়ে যেত, ফিরে আসার নিশ্চয়তা ছিল না।

চাঞ্চল্যকর এমন সব ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গুম কমিশন অব ইনকোয়ারিতে লিখিত অভিযোগ করেছেন একাধিক ভুক্তভোগী। নাম প্রকাশ না করলেও বিষয়গুলো স্বীকার করেছেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। প্রকাশ হওয়া এসব তথ্য দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গভীর উদ্বেগ জানিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তসহ অবিলম্বে দোষীদের বিচারের দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

বগুড়া পুলিশ লাইনে ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ-পশ্চিম কোণার দোতলার ভবনটিতে এমন ঘটনা ঘটেছে।

সম্প্রতি ঢাকায় গুম কমিশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন জানিয়েছেন, বগুড়া পুলিশ লাইন্সে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে বিভিন্ন জায়গা থেকে বন্দিদের নির্যাতন করা হতো। পুলিশ লাইন্সে গোপন বন্দিশালার বিষয়ে তাদের কাছে অনেক অভিযোগ এসেছে। তদন্ত চলছে, তদন্তাধীন বিষয়ে এ বিষয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না।

পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ২০১৪ ও ২০১৮ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে শেখ হাসিনা সারা দেশে যেসব পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছেন, তারা আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই করেছেন। বগুড়া ও এর আশপাশের এলাকার আতঙ্কের নাম ছিল তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মন্ডল।

গুম কমিশনে দেওয়া অভিযোগ মতে, গুম করে জঙ্গি মামলায় ফাঁসানোর নেতৃত্বে ছিলেন বগুড়ার তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মন্ডল ও মো. আব্দুল জলিল। জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম, পরিদর্শক ইমরান মাহমুদ তুহিন, উপ পরিদর্শক (এসআই) জুলহাস, মজিবর রহমান, আলমগীর হোসেন, এএসআই রাশেদ এএসআই রাসেল এবং কনস্টেবল সালাম ও গোবিন্দসহ গ্রুপের অনেকে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফ মন্ডলের ঘনিষ্ঠজন (ভাই) হিসেবে পুলিশ বিভাগে পরিচিত কাহালু ডিগ্রি কলেজের একজন প্রভাষক তার অন্যতম প্রধান সোর্স।

বিনিময়ে বগুড়া, গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় পুলিশের নিয়োগসহ অবাধ বিচরণ ছিল তদবির বাণিজ্যে। শুধু তাই নয়, জুলাই আন্দোলনকালীন তার ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

বগুড়া পুলিশ লাইনে দায়িত্ব পালন করা এক পুলিশ সদস্য জানান, পুলিশ লাইন্সে যোগদানের পর তিনি বন্দিদের সেখানে দেখতে পান। ২০১৭ সালে কমপক্ষে ৩০ জন নিরপরাধ মানুষকে নেওয়া হয় সেখানে। যার নেতৃত্বে ছিলেন পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান। মূল দায়িত্বে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফ মন্ডলের সঙ্গে কাজ করতেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল জলিল। টার্গেট আকটদের নির্যাতনে হত্যার পর রাতের আধারে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু দেখানো হতো। কখনও হত্যার পর পেট কেটে নদীতেও মরদেহ ফেলে দেওয়া হতো।

ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে এই পুলিশ সদস্য বলেন, নির্বিচারে অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করে কীভাবে এখনো এসপির দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের তো ফাঁসি হওয়া উচিত।

সূত্র দাবি করে, গুম হওয়া অনেককেই ২০১৭ সালের ২৬ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলোচিত জঙ্গিবিরোধী অভিযান ‘ঈগল হান্ট’ মামলায় আসামি করা হয়েছিল।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাগপুর ইউনিয়ণের বাসিন্দা হাফিজ উদ্দিন দৈনিক জানান, ২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে তার ছোট ভাই মফিজ উদ্দিন নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন পানামা হিলি পোর্ট লিমিটেডে কর্মরত থাকাবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে যায়। এরপর থেকে অদ্যাবধি তার ভাইকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর শিবগঞ্জ থানায় মামলা করতে গেলে মামলা নেয়নি, আদালতে মামলা করলেও থানা পুলিশ তা এজাহার হিসেবে গণ্য করেনি।

বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী বগুড়া শহর শাখার আমির আবিদুর রহমান হোহেল জানান, বিগত ১৬ বছর দেশে বহু অন্যায়, অত্যাচার হয়েছে। বহু মানুষ হত্যা হয়েছেন, গুম হয়েছেন মিথ্যা মামলায় কারাভোগ করেছেন। বগুড়া পুলিশ লাইনে বন্দিশালার বিষয়টি তিনিও শুনেছেন। তার জানামতে, বগুড়াতে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, আলাউদ্দিন হোসেল, রাজ্জাক, সাব্বির শাহরিয়ার শুভ, রশিদুল ইসলাম, মাহবুবুর রহমান ও নাহিদুর ইসলামকে পুলিশ গুম করে নির্যাতন চালিয়েছেন। আল্লাহর অসীম কৃপায় কিছুদিন পরে পৃথকভাবে মামলা দিয়ে অন্য কোথাও পৃথকস্থানে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

বগুড়া জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন দৈনিক জানান, বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ দল-মতের বিরুদ্ধে গেলেই পুলিশকে দিয়ে নানাভাবে মিথ্যা মামলাসহ গুম-খুন করাতো। সবশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে বগুড়ার তৎকালীন পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী দায়িত্বরত অবস্থায় আগের মতোই পুলিশের একটি চক্র গুম, খুন ও অপহরণে ব্যস্ত ছিল।

তিনি বলেন, কাহালু উপজেলার মদনাই ইউনিয়নের বীরকেদার নিবাসী মদনাই ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনকে দুপচাচিয়া এবং বীরকেদার গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হৃদয়কে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারী পুলিশ। গণমাধ্যমের সহযোগিতা নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করলে কয়েকদিন পরে পুলিশ তাদেরকে সবকিছু গোপন রাখার শর্তে কৌশলে পৃথক স্থানে ছেড়ে দেয়।

বগুড়ার তৎকালীন এসপি মো. আসাদুজ্জামানকে সবশেষ কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট প্রধানের দায়িত্ব থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। ফোন বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল জলিলকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। আরিফুর রহমান মন্ডলের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

তবে ইন্সপেক্টর ইমরান মাহমুদ তুহিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি এ ধরনের কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন না, মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে।

এসআই জুলহাসের ফোন বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তৎকালীন বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ জানান, এ বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি। ওসি ডিবি আমিরুল ইসলাম পরে কথা বলবেন বলে ফোন কেটে দেন।

বগুড়ার পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা দৈনিক জানান, তিনি বিষয়গুলো সম্পর্কে শুনে থাকলেও গুম কমিশনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় কোনোরকম বক্তব্য দিতে পারবেন না।

 

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com