পলাশ আহসান
এবার রোজার আগে খিলগাঁও খলিলের মাংসের কথা খুব শোনা গেলো। টেলিভিশনে লাইভ হলো। লোকজন লাইন দিয়ে মাংস কিনলো। এর পর তার দেখা দেখি আরও অনেককে একই রকম উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে। তারা কেউ কেউ খলিলের চেয়েও কম দামে মাংস বিক্রি করেছেন। দিন দিনে আরও উদ্যোগ আসছে। কিন্তু ঢাকায় খলিলের মত প্রচার এখনও কেউ পাননি। প্রথম উদ্যোগ বলে কথা।
আসলে কেউ কোন উদ্যোগের শুরুতে থাকলে তিনি সব সময় কিছু সুবিধা এমনি এমনি পাবেনই। অন্যরাও স্বেচ্ছায় সেই সুবিধা দেবেন। মোদ্দাকথা প্রথম উদ্যাক্তকে সবাই সম্মান করেন। কারণ আর কিছু নয়, তার সঙ্গগুণেই অনেকেই একটি ভাল উদ্যোগে যুক্ত হন। আসলে দোষও যেমন এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে মধ্যে সংক্রমিত হয় গুণও তেমনি।
কিন্তু আজকের বাংলাদেশে আমাদের চোখে মানুষের গুণ খুব একটা প্রচার হয় না। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই বিস্ফোরণের সময়। কিন্তু এবার রোজার আগে কেন জানি মানুষের ভাল কিছু উদ্যোগ সামনে আসছে। যেমন দেখা গেলো চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ মুদি ব্যবসায়ী শাহ আলম মাত্র ১টাকা লাভে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন। দাম কমের কারণে শাহ আলমের দোকানে বেড়েছে বেচাকেনাও। অনেক দূর থেকে ক্রেতা আসছেন তাঁর দোকানে।
শাহ আলমের উদ্যোগের ঢেউ এসে লেগেছে, ঢাকার ধামরাইয়ে। সেখানেও আছেন আরেক শাহ আলম। তার সঙ্গে রুবলে আহমেদ নামে আরও একজন আছেন। তারা দুই বন্ধু প্রতি পণ্যে ২টাকা লাভ করার ঘোষণা দিয়েছেন। তারা মূলত ইফতারে ব্যবহৃত হয় এমন পণ্য বিক্রি করছেন। সেখানেও প্রচুর ক্রেতার ভিড়। ক্রেতারাই সাংবাদিকদের বলছেন, দুই বন্ধুর দোকানে মানুষ সকাল থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কেনেন। আর ওই দুই বন্ধু জানান, তাদের বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। বিক্রি বাড়লেই ভাল ব্যবসা হয় এর জন্যে ক্রেতা ঠকাতে হয় না।
দেশের বহু এলাকা থেকে এরকম নানা শুভ উদ্যোগের খবর আসছে ইদানিং। ঢাকা ও আশে পাশের এলাকায় কয়েকটি শিল্প গ্রুপ মিলে রেটে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির সরকারি উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। যে কারণে এবার রোজার আগে বাজারের দাম নিয়ে যতটা উদ্বেগ দেখা গিয়েছিল ততটা ছাপ পড়েনি জনজীবনে। সব শ্রেণির মানুষ কষ্ট করে হলেও রোজার খাবার যোগাড় করতে পারছেন।
আমি বলছি না বাজারে পুরোপুরি স্বস্তি ফিরেছে। কিন্তু একথা বলা যেতে পারে যে, আজ অল্প বিস্তর বিকল্প এসেছে একেবারে কম আয়ের মানুষের সামনে। কিন্তু মধ্যবিত্ত এখনও নানা কারণে সেই সুবিধার সামনে যেতে পারেনি। কিন্তু তারও যাওয়া দরকার। মধ্যবিত্তের সমস্যাতো আরও ভয়াবহ। একেবারে কম আয়ের মানুষ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে পরিচিত মানুষের কাছে ঋণ চাইতে পারে। কিন্তু মধ্যবিত্ত সব সময় সেটাও পারে না। তাই তার জন্যেও আজকের এই বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটে সুলভ বাজার দরকার।
এত কথা বললাম, এত উদাহরণ দিলাম কারণ একটাই। দেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্যে সুলভ বাজার দরকার। কিন্তু প্রচলিত যে বাজার পদ্ধতি, সেটা সবার নাগালের মধ্যে আসছে না। তাই একটি ধর্মীয় অনুভূতি সামনে রেখে, কখনও ব্যক্তিগত, আবার কখনও সরকারি উদ্যোগ নিতে হয়েছে। কর্পোরেট উদ্যোগ নিতে হয়েছে। কিন্তু এটা তো কোন স্থায়ী সমাধান নয়। রোজা চলে গেলেই সব বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু মানুষের ক্ষুধা তো রয়েই যাবে। সব শ্রেণির মানুষ এই সুবিধা চাইবে। তাই আমার প্রস্তাব, বাজারের এই মানুষ বান্ধব উদ্যোগগুলোকে সমন্বিত করা হোক। উদ্যাক্তাদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে বর্তমান শুভ উদ্যোগগুলোকে স্থায়ীরূপ দেয়া হোক।
একটু ভেবে দেখলেই দেখা যাবে, আজ যেসব উদ্যোগে মানুষের কাছে একটু কমদামে যারা পণ্য দিচ্ছেন, তিনি বা তারা সারা বছরই এভাবে পণ্য দিতে পারেন। তাহলে একসময় এই বিশেষ উদ্যোগের কাছে সব ক্রেতা আসতে থাকবেন। তখন বেশি দামের পণ্য নিয়ে কতদিন বসে থাকবেন বেশি দামের ব্যবসায়ী?
অনেকের কাছে বিষয়টি উচ্চ মূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের শিশু সুলভ সমাধান মনে হতে পারে। কিন্তু আরেকবার ভেবে দেখুন, এটাইতো হওয়ার কথা ছিল। একজন ব্যবসায়ী নির্ধারিত দামে পণ্য কিনবেন এবং সহনীয় লাভে সেই পণ্য বিক্রি করবেন। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমাদের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মানেন না বলেই আমাদের সমাজে এক অর্থনৈতিক অসাম্য। বলা বাহুল্য এই অসাম্যই সামাজিক যত অশান্তির কারণ।
খানিকটা আবেগাপ্লুত হয়ে, আমি এই রোজার বাজারের কিছু শুভ উদ্যোগ স্থায়ী করার কথা বললাম বটে। কিন্তু একটু পেছন ফিরলে দেখা যাবে, কাজটি মোটেও সহজ নয়। এই তো রোজার ক’দিন আগেই কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করা নিয়ে বিরোধের জেরে রাজশাহীর বাঘায় মামুন হোসেন নামে এক মাংস ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়। মামুনের পরিবার থেকে গণমাধ্যমে জানানো হয়েছিল, হত্যাকারীরা মামুনের প্রতিযোগী মাংস ব্যবসায়ী।
আজকে বাজারের অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে গেলেই অবধারিতভাবে সিন্ডিকেট প্রসঙ্গ চলে আসে। সংসদের মত যায়গায় দাঁড়িয়ে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের পর্যন্ত এই সিন্ডিকেটের জোরের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে দেখা গেছে। সুতারাং কোন শুভ উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করারও চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু এই রোজায় সেই চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে কিছু উদ্যাক্তার কিছু সফল উদ্যোগ নিশ্চয়ই আমাদের সাহসী করে। বাজার অর্থনীতির এই চরম দুঃসময়ে এর চেয়ে ভাল আশার বাণী আর কী হতে পারে?