ডেস্ক রিপোর্ট॥
এই মুহূর্তে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে সরাসরি প্রভাব ফেলছে দ্রব্যমূল্য। রমজান মাস শুরু হওয়ার আগে থেকেই লাগামছাড়া হয় বাজার। তবে রমজানের দ্বিতীয়ার্ধে এসে বেশকিছু পণ্যের দাম কমেছে।
বাজার অর্থনীতিবিদদের মতে, এখানে সরকারের সফলতার চেয়ে পণ্যের মৌসুম এবং দুয়েক ক্ষেত্রে জনগণের বয়কট ঐক্যকে এগিয়ে রাখেন। বিশেষ করে পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল ও চিনির মতো পণ্যের দাম কমে গেছে। এছাড়া সবজির দামও নিম্নমুখী। আশা করা হচ্ছে ঈদের পরও নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে। যদিও জনসাধারণের ভেতর উদ্বেগ এখনো রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে টানা এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর অবস্থান করেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম কমায় ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারিতে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমা সত্ত্বেও ভোক্তা মূল্যস্ফীতি চলতি অর্থবছরের জন্য সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ওপরে আছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। এটি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়। এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা উচিত। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতেও যে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল, তা থেকে বেশিরভাগ দেশ বেরিয়ে আসলেও বাংলাদেশে এটি কমার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও আরো নানা বিষয় প্রভাব ফেলেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অর্থপাচার এবং বাজার সিন্ডিকেট দমনে ব্যর্থতা। দেশে ডলার ও রিজার্ভ সংকট থাকলেও সরকার নিজস্ব ব্যয় কমাতে পারেনি। উল্টো টাকা ছাপানোর মতো পদক্ষেপের কারণে বাজারে অর্থ সরবরাহ থাকায় মুদ্রাস্ফীতি জনিত মূল্যস্ফীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়। ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা আত্মীয় স্বজনের কাছে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। আগামী কোরবানি ঈদ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলা আশা করা হচ্ছে। দেশে গত মার্চ মাসে বৈধপথে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ২ বিলিয়ন (১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ২১ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা (প্রতি এক ডলার ১১০ টাকা হিসাবে)। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে ২০২ কোটি ২৪ লাখ ডলারের রেমিটেন্স দেশে এসেছিল। আর এ বছরের মার্চ মাসে এসেছে ১৯৯ কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার।
অপরদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ধারা অব্যাহত আছে। তবে ব্যাংকগুলো এখনো ১২১ থেকে ১২২ টাকা ধরে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে রেমিট্যান্স কিনছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় দর নির্ধারিত রয়েছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। সব মিলিয়ে ডলারের বাজার পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আশা করা হচ্ছে ডলার সংকট কেটে যাবে এবং আমদানিতে এলসি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
বিনিয়োগ:
ডলার সংকট, অর্থ পাচার, সেবা প্রাপ্তিতে ভোগান্তি ও জ্বালানি সংকটের মতো বিষয়গুলোর কারণে গত একবছরে দেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমছে বলে মনে করা হয়। তবে জাতীয় নির্বাচনের পর আবার উদ্যোক্তারা বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসছে। এক্ষেত্রে আরেকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। আর সেটি হলো ঋণের সুদের হার তুলে নেয়া। এর ফলে ব্যাংক ঋণের বিপরীতে উচ্চহারে সুদ আদায় করার সুযোগ নেবে ব্যাংক।
আমদানির গতি স্বাভাবিক রাখা ও আইএমএফের ঋণ পেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্ভব সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একদিকে রয়েছে দেনা পরিশোধের প্রবল চাপ এবং অপরদিকে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ানোর বড় চ্যালেঞ্জ তো আছেই। আবার আমদানি ব্যয় তথা আমদানির জন্য এলসি খুলতে বিপুল অঙ্কের ডলারের চাহিদা লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনেক বিষয় সামনে রেখে বেশ সাবধানে এগোতে হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ আপাতত ২ হাজার কোটি ডলারের আশপাশে ধরে রাখতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ৪ মার্চ পর্যন্ত দুই খাতেই রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ছিল। গ্রস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৫২৫ কোটি ডলার এবং নিট রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৯৯ কোটি ডলার। রিজার্ভ এখন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও জুনের আগে আরও তিনটি বড় দেনা পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনার দুটি কিস্তি এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ধার করা ডলার পরিশোধ করতে হবে। মার্চ ও এপ্রিলের আকুর দেনা পরিশোধ করতে হবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। মে ও জুনের দেনা শোধ করতে হবে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে। এই দুই খাতের দেনা বাবদ প্রায় ২৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দেনা বাবদ শোধ করা হয়েছে ১২৯ কোটি ডলার। ফলে আমদানি যেহেতু বাড়ছে, সেহেতু দেনা শোধের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। এছাড়া ব্যাংকগুলো থেকে ডলার ধার নিয়ে রিজার্ভ বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এগুলো ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী পরিশোধ করতে হবে। চলতি মাসেই শোধ করতে হবে সাড়ে ৬ কোটি ডলার। ফলে এসব দেনা শোধ করার পর রিজার্ভ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ ৯ মাসের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে ৩ হাজার ৭২০ কোটি ২৬ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের, যা আগের বছরেরই একই সময়ের চেয়ে পাঁচ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি। আগের বছরের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে রপ্তানি হয়েছিল ৩ হাজার ৫২৫ কোটি ২৪ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। তবে জুলাই-মার্চ ৯ মাসের মোট রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যপূরণ হয়নি। জুলাই-মার্চ ৯ মাসের কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ৬২৬ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার।
নতুন বাজেট ঘোষণা জুনে
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নতুন বাজেট ঘোষণা করা হবে জুন মাসে। টাকার অঙ্কে ৮ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে এবারের বাজেটের আকার। আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বাজেট উপস্থাপন করবেন। এরই মধ্যে তিনি বলেছেন, দেশের অর্থনীতি ভালো আছে, আগামীতে আরো শক্তিশালী হবে।