সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৩ পূর্বাহ্ন

বিপাকে খামারীরা

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২, ২.৩৪ পিএম
  • ২১ বার পড়া হয়েছে

সরকার ২০১৫ সালে ভারতের গরু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার পর দেশে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার গরুর খামার। বিশেষ করে পাবনা, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নাটোর, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ কয়েকটি জেলায় বিপুল সংখ্যক গরু প্রতিপালন শুরু হয় গড়ে উঠে হাজার হাজার পশুর খামার। পদ্মা, তিস্তা, যমুনা, ব্রক্ষ্মপুত্র নদ-নদীগুলোর হাজার হাজার চরাঞ্চলে গরুর খামার গড়ে উঠে। শুধু তাই নয়, ঈদুল আজহায় গরুর চাহিদা বেশি থাকায় উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায় প্রতিটি গ্রামে কৃষকরা ঘরে ২ থেকে ৪টি করে গরু প্রতিপালন করেন। এই গরু দেশের ঈদুল আজহার কোরবানিসহ সারাবছর গোশতের চাহিদা মেটায়। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছে দেশের কৃষিখাত ও গরুর প্রতিপালনে। গরুর খাদ্যের দাম বেশি, কৃষিপণ্য উৎপাদন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি এবং কৃষি উৎপাদন উপকরণও কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। এরমধ্যে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। যার তাণ্ডবে দেশের অনেক অঞ্চলে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে কৃষকের ফসল। সর্বোপরি সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত কৃষকরা, বাজারে তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এতে লোকসানের আশঙ্কায় কৃষকের কপালে পড়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। আর আর্থিক সঙ্কটের কারণে গ্রামের যেসব কৃষক ২-৪টি করে গরু প্রতিপালন করতেন; তাদের গরু বিক্রি করে সংসার চালাতে হচ্ছে। আর খামারীরা মূলধনের সঙ্কটে পড়ে গরু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। চরাঞ্চলের গরুর বাথানগুলো থেকে গরু কমতে শুরু করেছে ওই আর্থিক সঙ্কটের কারণেই। খামারিরা বলছেন, পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে তাতে আগামী কয়েক মাসে অর্ধেক খামার বন্ধ হয়ে যাবে। খামার বন্ধ হলে আগামী ঈদুল আজহায় কোরবানির গরু সঙ্কট হবে।
দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়ার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, মূলধনের অভাবে বড়-ছোট অনেক খামার বন্ধ হওয়ার পথে। কৃষকরা কৃষিপ্রণোদনা তথা সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ পাচ্ছেন না। অনেক প্রতিষ্ঠিত খামারিও ঋণখেলাপির জালে আটকা পড়ছেন। তাদের কেউ কেউ ব্যাংকের মামলা মাথায় নিয়ে ঘরছাড়া। সেসব এলাকার কৃষক ও খামারিরা মনে করছেন, ব্যাংকগুলো সহায়তার হাত বাড়ালে এবং সরকার প্রণোদনা দিলে তবেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা সম্ভব।
বগুড়া, সিরাজগঞ্জ গাইবান্ধা ও পাবনার বেশ কিছু শীতকালীন ও বারোমাসি সবজির মাঠ, মুরগির খামার, গরুর খামার, মাছের খামার ঘুরে দেখা গেছে, অনেকে সীমিত পরিসরে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ তা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছেন। কৃষক ও খামার মালিকরা বলছেন, উৎপাদন খরচের সঙ্গে পাল্লা দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া পণ্যের ন্যায্যমূল্যও পাচ্ছেন না। অনেকে আগামী মৌসুমে পেঁয়াজ ও ধান চাষ ছেড়ে দেয়ার কথা জানিয়েছেন। পুঁজি সঙ্কটে পড়া অনেকে চাইছেন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
পাবনা সদর উপজেলার প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারি সমিতির আহ্বায়ক হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ না দিলে টিকে থাকা অসম্ভব।
পদ্মা, যমুনা ও তিস্তার চরাঞ্চলের স্থানীয় গরুর খামারিদের অনেকে বলছেন, গরুর খাদ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। উৎপাদন খরচ মেটাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। মৎস্য চাষিদের কথায়ও একই সুর। ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে খামার পরিচালনা তাদের পক্ষে দুরূহ। তারা বলছেন, আর্থিক সঙ্কটের কারণে অনেকে গরু বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। কেউ কেউ দু’একটি গরু বিক্রি করে সংসার চালালেও খামারিদের অনেকেই আর্থিক সঙ্কটে কারণে খামার বন্ধ করার চিন্তাভাবনা করছেন।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় শুধু প্রান্তিক বা মধ্যবিত্ত চাষিরা ক্ষতির মুখে ছিলেন। কিন্তু এখন উচ্চবিত্ত চাষিরাও ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। সরকারের কোনো প্রণোদনা না পেলে বড় খামারিরাও উৎপাদন বন্ধ করে দিতে পারেন। উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় পুঁজির সঙ্কটে এরই মধ্যে বেশ কিছু খামার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

সিরাজগঞ্জের চাষিদের কেউ কেউ আক্ষেপ প্রকাশ করে জানান, জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত পাবনার অনেক চাষি ক্ষতির মুখে পড়ে ব্যাংক ঋণ খেলাপির তালিকায় চলে গেছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অনেকে পালিয়ে ফিরছেন। অথচ তাদের ঋণ পুনঃতফসিল করা হলে তারা দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। তাদের অভিযোগ, একশ্রেণির অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য প্রকৃত চাষিরা বঞ্চিত হচ্ছেন। চাষিরা হাত গুঁটিয়ে নিলে কৃষি উৎপাদনে ভাটা পড়বে। দেশে খাদ্যপণ্যের সঙ্কট দেখা দেবে। আগামী ঈদুল আজহায় কোরবানির গরুর সঙ্কট দেখা দেবে। একই অবস্থায় পড়েছেন নতুন চাষি ও নারী উদ্যোক্তারা।

চাষিরা বলছেন, সরকারি ঘোষণা আর ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার মধ্যে মিল নেই। সরকার বলছে বর্গা চাষিরা জামানত ছাড়া ঋণ পাবেন। কিন্তু ব্যাংক তা দিচ্ছে না। এমনও হচ্ছে, কৃষকের জন্য দেয়া সরকারি প্রণোদনার ঋণ ব্যবসায়িরা নিয়ে নিচ্ছেন। কৃষকের প্রকৃত খবর জানে কৃষি বিভাগ। কৃষি বিভাগের সুপারিশের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে কৃষকের ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা থাকা দরকার। এক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যেন কৃষি বিভাগের পরামর্শ মানতে বাধ্য থাকে সে নিয়ম করা জরুরি। কৃষকরাই দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করছেন। তাই খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় এবং সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কথা মাথায় রেখে কৃষককে আগে আগে বাঁচাতে হবে।

পাবনার ফরিদপুর উপজেলার রতনপুর গ্রামের দুগ্ধ খামারি হেকমত আলী বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে গরুর খামার করছি। গাভী পালন করে তাদের সংসারে উন্নয়নও হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তারা লাভের মুখ দেখা দূরের কথা খামার ধরে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্বল্প সুদে ঋণ পেলে তাদের পৈত্রিক খামারটি টিকিয়ে রাখা যাবে।

বগুড়া, রংপুর, সিরাজগঞ্জ জেলার খামারি ও গরু প্রতিপালনকারীদের এই অবস্থা। পাবনার নারী কৃষি উদ্যোক্তারাও জানিয়েছেন হতাশার কথা। জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার পাওয়া চাষি ও পাবনার অন্যতম নারী উদ্যোক্তা বেইলি বেগম জানান, তার ব্যক্তিগত ৩০ বিঘার খামারসহ তার স্বামীরও খামার রয়েছে। নগদ অর্থের অভাবে এবং উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় তাদের খামারগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। সীমিত সুদে পর্যাপ্ত ব্যাংকঋণ না পেলে বন্ধ হয়ে যাবে খামার।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ভারতের গরু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধ হওয়ার পর গোশতের সঙ্কটে পড়ে দেশ। তখন দেশে গরুর খামারসহ কৃষি খামারের সংখ্যা ছিল ৩ লাখের মতো। গরুর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২০১৮ সালে দেশে খামারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ লাখ ৪২ হাজার ৯৯১টি। এ সময় কোরবানীর ঈদে গরুর দাম বেশি হওয়ায় দেশের গ্রামের মানুষ নিজেরা ঘরে ২-৪টি করে গরু প্রতিপালন করতে শুরু করেন। উত্তরাঞ্চলের অনেক কৃষক গরুর খামারের দিকে ঝুকে পড়েন। গরুর অসংখ্য খামার গড়ে উঠে। দেশে প্রতিপালন করা গরু কোরবানীর চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়। অথচ এক সময় কোরবানীর পশুর জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীল হতে হতো। এক প্রতিবেদনে জানানো হয় ভারতের গরু বাংলাদেশে প্রবেশ প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়েছে। গত ঈদুল আজহার সময়সহ সারাবছর বৈধ পথে ভারত থেকে গরু আমদানির সংখ্যা ছিল ৯২ হাজার। অথচ ২০১৩ সালে ভারত থেকে গরু আসার সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ। ওই প্রতিবেদনে বিগত বছরগুলোর হিসাব অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চলের ৭টিসহ মোট ২৩টি করিডর দিয়ে ভারত থেকে ২০১৪ সালে ২০ লাখ, ২০১৫ সালে ৮ লাখ, ২০১৬ সালে ১১ লাখ, ২০১৭ সালে ৯ লাখ ও ২০১৮ সালে ৭ লাখ গরু বৈধ পথে বাংলাদেশে আসে। অথচ এখন দেশি গরুই দেশের চাহিদা মেটাচ্ছে। এখন যদি খামারি ও গ্রামগঞ্জের গরু প্রতিপালনকারী কৃষকদের সহায়তা না করা হয়, তাহলে অনেক গরু ও কৃষিখামার বন্ধ হয়ে যাবে। তখন গরুর গোশতের চরম সঙ্কটে পড়বে দেশ।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com