স্টাফ রিপোর্টার॥
বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২১ এর প্রতিপাদ্য বিষয় “ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন” (বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার) এবং “প্রকৃতি সংরক্ষণ করি, প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করি”, এই স্লোগানকে সামনে রেখে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) শনিবার বেলা ১১ টায় পরিবেশকর্মী ও তরুণদের অংশগ্রহণে “তরুণ প্রজন্মের হাতেই প্রকৃতি ও পরিবেশের ভবিষ্যৎ“ শীর্ষক এক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা এবং পদক্ষেপকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিবছর ৫ জুন বিশ্বব্যাপী বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। পবা’র সম্পাদক ও গ্রিন ফোর্স সমন্বয়ক মেসবাহ সুমনের সঞ্চালনা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সোবহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, প্রকৃতির উপর নানা ধরনের অত্যাচার, অনাচার হবার ফলে নানা ক্ষতিকারক ভাইরাস পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে বিপর্যয় ডেকে আনছে, তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তরুণদের সচেস্ট হতে হবে। সম্পদ আহরনের লোভে প্রকৃতিকে ধংস করা থেকে বিরত থাকতে সচেস্ট হতে হবে। শিক্ষা সচেতনতার সঙ্গে আমাদের পরিবেশ সচেতনতার শিক্ষাও দরকার। বর্ণ পরিচয়ের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে পরিবেশ পরিচয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রকৃতিকে পুরনো সজ্জায় ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণের বিভিন্ন উদ্যোগে তরুণরা এগিয়ে আসছে, এটা আশা জাগানিয়া খবর।
অনুষ্ঠানে আলোচ্য বিষয়ের উপর মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন পবার সম্পাদক মেসবাহ সুমন। প্রবন্ধে তিনি বলেন, বাংলাদেশ তারুণ্যের শক্তিতে বলীয়ান। আমাদের যত সমস্যাই থাক সম্ভাবনা অসীম। এ দেশের বড় সম্পদ তারুণ্যশক্তি। আমাদের তারুণ্যশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। দেশের ঐতিহাসিক সব অর্জনের সঙ্গে তরুণসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমরা এখন জনসংখ্যা সুবিধা তত্ত্বের মধ্যে আছি। এই সুবিধা ১৫ থেকে ২০ বছর হয়তো থাকবে। আমাদের প্রতিবেশব্যবস্থা ঠিক না থাকলে এসব সুবিধাকে কাজে লাগাতে পারব না। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে তরুণ প্রজন্মকে যত বেশি যুক্ত করা যাবে, আন্দোলন ততই শক্তিশালী হবে। কোথাও জলাশয় ভরাট হলে, পার্ক নষ্ট করলে যে স্থানীয় গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠার কথা, সেটা এখন তেমন দেখা যায় না। যার ফলে বাস্তুতন্ত্র থেকে স্থানীয় জলবায়ু, সবকিছুতেই তার প্রভাব পড়ছে। ইকোসিস্টেম রক্ষা করতে না পারলে বড় বড় অট্টালিকা, তথ্যপ্রযুক্তি কোনো কাজে আসবে না। পরিবেশ রক্ষায় জনসচেতনতা জরুরি। নতুন প্রজন্মের সকলের সমবেত এবং শক্তিশালী প্রচেষ্টাই পারে প্রতিবেশকে অক্ষুন্ন এবং সমৃদ্ধ রেখে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে। ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে যে ক্ষতি হচ্ছে তার মাত্রা তরুণদের বুঝাতে পারলে মোকাবিলা করার রাস্তা তৈরি সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন সাংগঠনিক উদ্যোগ এবং আন্দোলনগুলি কিশোর তরুণদের মধ্যে পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ে দায়বদ্ধতা তৈরী এবং জাতীয় নীতি তৈরীতে প্রভাব বিস্তারে কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
২০২০ সালে প্রকাশিত ব্যানবেইসের শিক্ষা সমীক্ষা অনুসারে দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব মিলিয়ে প্রায় ৩ কোটি ৯৮ লক্ষের বেশি শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত আছে। পরিবেশ শিক্ষার গুরুত্ব অনুভব করে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক সকল প্রকার শিক্ষা ব্যবস্থা ও মাধ্যমে পরিবেশ সংক্রান্ত জ্ঞান ও তথ্যের ব্যাপক অন্তর্ভুক্তি ও প্রসার নিশ্চিত করা সুযোগ রয়েছে। এতে করে শিক্ষার্থীরা স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশগত সমস্যা বিশ্লেষণ করতে পারবে। বর্তমান বাস্তবতায় অনলাইনে পরিবেশ বিষয়ক বিভিন্ন কোর্স ডিজাইন করে ছাত্র-ছাত্রী তথা নতুন প্রজন্মকে পরিবেশ সচেতনতা ও দক্ষতা বাড়ানো যায়।
আমাদের নতুন উদ্যোক্তরা অধিকাংশই তরুণ। ব্যবস্থাপক ও কর্মীবাহিনী তরুণ। তরুণ উদ্যোক্তাগণ শিল্প-কারখানায় সবুজ প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা চালু করতে পারেন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাস্তুসংস্থান পুনরুদ্ধার হয় এবং প্রকৃতি সুরক্ষিত থাকে এমন ব্যবসায়িক মডেলের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের উদ্যোক্তারা সবুজ অর্থনীতির বাস্তবায়ন করতে পারেন।
মূল প্রবন্ধের উপর আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, বানিপা’র সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ রাসেল, বিজিএমইএ-এর হেড অব সাসটেইনেবিলিটি (জয়েন্ট সেক্রেটারি) মনোয়ার হোসেন, পরিবেশ বার্তার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, পবার সম্পাদক ব্যারিষ্টার নিশাত মাহমুদ, দি ডেইলি ইন্ডাস্ট্রির কনসালটেন্ট এডিটর গোলাম মোস্তফা জীবন, গ্রিন ফোর্স সদস্য ফারজানা ইয়াসমীন পপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ সংসদের সভাপতি আবু সাদাত মোঃ সায়েম।
অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রকৌশলী আবদুস সোবহান বলেন, এমুহূর্তটি আমাদের সকলের- বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের। আমরা সময় ফিরিয়ে দিতে পারি না। তবে আমরা গাছপালা লাগাতে পারি, আমাদের শহরগুলো সবুজ করতে পারি, আমাদের বাগানগুলো পুণনির্মাণ করতে পারি, আমাদের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন করতে পারি এবং নদী ও উপকূল পরিষ্কার করতে পারি। জীবন ও জীবিকার জন্য প্রকৃতি ও প্রতিবেশ সুরক্ষায় আমাদের প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ এবং সর্বস্তরের জনগণের বিশেষ করে যুব সমাজের সক্রিয় অংশ গ্রহণ।
বানিপা’র সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ রাসেল বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় গাছের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কমিটি করে গাছ রক্ষা করা যেতে পারে। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্লাস্টিকপণ্য পরিহার, পায়ে হাঁটাসহ বাইসাইকেল চালানো ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব কাজে প্রনোদনা দিয়ে হলেও তরুণদের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
বিজিএমইএ-এর হেড অব সাসটেইনেবিলিটি (জয়েন্ট সেক্রেটারি) মনোয়ার হোসেন বলেন, তরুণ উদ্যোগক্তারা পরিবেশে বান্ধব। দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা এখন পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনে আগ্রহী। অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বা ব্র্যান্ড তাদের সোর্সিং তালিকায় পরিবেশবান্ধব কারখানা রাখতে চায়। বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি সংখ্যক পরিবেশবান্ধব (গ্রিন ফ্যাক্টরি) পোশাক কারখানা রয়েছে।
আলোচনায় অন্যান্য বক্তারা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবেশ বাঁচানোর প্রথম পদক্ষেপ তরুণ প্রজন্মকে নিতে হবে। পরিবেশগত শিক্ষাতেই রয়েছে পরিবেশগত সমস্যার সমাধান। সব আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে পরিবেশ শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে যে ক্ষতি হচ্ছে তার মাত্রা বুঝতে পারলে মোকাবিলা করার রাস্তা তৈরি সম্ভব হবে। সবাইকে যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার ও প্রকৃতি সংরক্ষণে প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে অনলাইন আলোচনা থেকে পবা’র সুপারিশসমূহ: পরিবেশ রক্ষা করে সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়ায় পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে স্কুল, কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতে হবে। শিশু-কিশোর-তরুণদের পরিবেশ মনস্ক করতে ও পরিবেশ শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিবেশ ক্লাব গঠন করার উদ্যোগ নিতে হবে। ইকোসিস্টেম কে জানতে বুঝতে ও পুনরুদ্ধার করতে কিশোর-তরুণদের মধ্যে পরিবেশ ও প্রকৃতি বিষয়ে আরও বোঝাপড়া, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জ্ঞানের প্রয়োজন। পরিবেশ অধিদপ্তর , দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় সমসাময়ীক সমস্যাকে আলোকপাত করে কিশোর-তরুণদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সহজবোধ্য ভাষায় ও সহজে ব্যবহারযোগ্য অনলাইন কোর্স চালু করতে পারে।
ক্স বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের জন্য, পরিবেশগত দক্ষতা এবং জ্ঞানের বিকাশকে অনুপ্রাণিত করতে তরুণ প্রজন্মকে ‘ইকোপ্রেনার’ হতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অর্থনৈতিক লাভ এর পাশাপাশি আমাদের ইকোসিস্টেম এর মূল্য সম্পর্কে জানতে হবে। রেসপন্সিবল ট্যুরিজম অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটকদের আচার-আচরণ ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ এর জন্য যথাযথ নিয়মাবলী তৈরী করে প্রচারে ব্যবস্থা করতে হবে।
জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ পাহাড় ও হাওর প্রতিবেশব্যবস্থা সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতি জরুরী। পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার জন্য প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে কোয়ালিটি ট্যুরিজমের কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
‘জাতীয় পরিবেশ নীতি, ২০১৮’ যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষ কেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারা নিশ্চিত করতে কবে।
নগর পরিকল্পনায় প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পরিবেশগত বিপর্যয় এড়াতে দেশের স্থানীয় পর্যায়ের সকল উন্নয়নকে পরিকল্পনার মধ্যে আনতে হবে।