বাঙালির আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অবদান অবিস্মরণীয়। এই আন্দোলন শুধু মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন ছিল না, এটি ছিল নিজস্ব জাতিসত্তা, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার আন্দোলন। যা জাতিসত্তার স্বরূপ নির্ধারণে বাঙালি সংস্কৃতির সীমা নির্ধারণ করে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ইতিহাস বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়- এর মূল ইতিহাসের গভীরে গ্রোথিত। বাঙালির আত্মপরিচয়ের রাজনীতি আবর্তিত হয় ক্ষমতার রাজনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে কেন্দ্র করে। বাংলা এক প্রাচীন সভ্যতার আবাসভূমি। এই দেশ বহুবার বিদেশি শক্তি দ্বারা আক্রান্ত ও শাসিত হয়েছে। বহু কালব্যাপী বাঙালির ঐতিহ্য-উত্তরাধিকার যে সুস্পষ্ট অবয়ব গ্রহণ করে তা প্রকৃতজাত ও দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। বাঙালির আত্মপরিচয়ের রাজনীতি প্রতিমূর্ত হয়ে উঠে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ মন্ত্রে।
ইতিহাসের ধারায় আমরা দেখি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল এবং ভারতের বাহির থেকে আসা বিভিন্ন অভিযাত্রী নরগোষ্ঠীর সাথে বাঙালি জাতির মিশ্রণ ঘটেছে। গুপ্ত, পাল, সেন, বর্মণ, কম্বেজাখ্য, খড়গ, তুর্কি, আফগান, মোঘল, পুর্তুগিজ, ইংরেজ, আর্মেনিয় প্রভৃতি বহিরাগত জাতি শাসন করেছে এবং এই অঞ্চলে তাদের রক্তের ধারা রেখে গেছেন। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এ সংকরত্ব আরো বেগবান হচ্ছে। নৃগোষ্ঠীর গ্রহণ-বর্জনের অভিজোজন ধারায় গড়ে উঠেছে যে বাঙালি জাতি, তার সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মানবিক মূল্যবোধ, সংগ্রামশীলতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সক্ষমতা। বাঙালির ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে এর প্রতিফলন দেখতে পাই। যার সফল পরিণতি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন; যে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতীয়তাবাদ পূর্ণ কাঠামো লাভ করে।
মূলত বাঙালির আত্মপরিচয়ের রাজনীতির আবর্তন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের উন্মেষ ঘটায় একটি ঐড়সড়মবহবড়ঁং, বা সমরূপ রাষ্টের বৈশিষ্ট্যে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সমজাতীয়তার ভাব এত প্রবল হলো যে, ভাষার দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলন যখন স্বাধীকার আন্দোলনে রূপ নিল, সেই অসহযোগ আন্দোলনে পূর্ব বাংলা জুড়ে ধ্বনিত হয়েছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার নির্মাণ-বিনির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ভাষা আন্দোলনই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি ও চেতনা এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল অনুপ্রেরণা, যা বাঙালির আত্ম পরিচয়ের রাজনীতিকে সার্থক করে তোলে। তাই ভাষা আন্দোলন বাংলার জনগণের মধ্যে নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করে। এই আন্দোলন বাঙালিকে সচেতন, সক্রিয় ও প্রাণিত করেছে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনায়।
সংঘাত-মানসিকতা বাঙালির রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। বাঙালির আত্মপরিচয়ের রাজনীতির মূল আশ্রয় তার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। সংস্কৃতিচর্চা আর সাংস্কৃতিক চেতনা অভিন্ন নয়। চেতনাহীন সংস্কৃতি চর্চায় বিনোদন লাভ করা যায়, তাতে জাগরণ সম্ভব নয়, আত্মজাগরণহীন জাগরণকে তাই চেতনা বলা যায় না। বাঙালির আত্মপরিচয়ের সূত্রটি নির্মিত হয়েছে তার ভাষা কেন্দ্রিক আত্মজাগরণকে অবলম্বন করে। ভাষা, সংস্কৃতি ও দেশের সঙ্গে নিজেকে সচেতনভাবে যুক্ত করার প্রয়াস জোরালোভাবে দেখা যায় উনিশ শতক থেকে। উপনিবেশের সূচনা থেকে আমাদের ভাব ও সাংস্কৃতিক পরিসরে জায়গা করে নিতে থাকে পশ্চিমের ঔপনিবেশিক জ্ঞান ও সংস্কৃতি। এর প্রভাবে বাঙালির আত্মপরিচয়ও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে। তবে পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়ার বাসনাই হৃষ্ট করে বাঙালির আত্মপরিচয়, যা
প্রতিফলিত হয় বায়ান্নর চেতনায়। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার এবং জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে এর বিস্তার।
মূলত ভাষা আন্দোলনের চেতনা বাঙালির আত্মপরিচয়ের আকাক্সক্ষা থেকে জাত যা পরিণত হয়েছে জাতীয় ঐক্যের ও সমৃদ্ধির প্রতীক। বাঙালির আত্মপরিচয়ের রাজনীতির চূড়ান্ত পরিণতি জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন থেকে জাতিরাষ্ট্রে বিবর্তনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনজাত বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনা। নিত্যদিনের হাজারো সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাওয়ার যে সহজাত প্রবৃত্তি তা বাংলাদেশের মানুষ লাভ করেছে বায়ান্নর সংগ্রামী চেতনা থেকে।
লেখক: মুহাম্মদ আশরাফুল করিম, গবেষক ও গ্রন্থাগারিক