রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪৮ অপরাহ্ন

ভ্যাট আদায়ে বিপর্যয় চার কারণে

  • আপডেট সময় শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২.০৩ পিএম
  • ২৬ বার পড়া হয়েছে

স্বর্ণময়ী মোস্তফা ঐশী:

জাতীয় বাজেটে ভ্যালু এডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) আদায়কে প্রধান খাত হিসেব করে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় গত কয়েক বছর ধরে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও রাজস্ব আয়ের প্রধান খাত ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য বছরের তুলনায় উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন কমে যাওয়া, ভ্যাট আহরণের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের শৈথিল্য, ভোজ্য তেলসহ বিভিন্ন পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি এবং মাঠ প্রশাসনের সঠিক নজরদারির অভাবে ভ্যাট আদায়ে বিপর্যয় নেমে এসেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এই রাজস্ব আহরণের জন্য প্রধান খাত হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে ভ্যাট আদায়কে। চলতি অর্থবছরেও এনবিআরের তিনটি খাতের মধ্যে আয়করের লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং আমদানি-রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা থেকে আরো ১৪ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই বৈশ্বিক পণ্যের দাম বাড়া এবং ডলারের দামের কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এগিয়ে রয়েছে। আয়কর খাতেও রাজস্ব আহরণের গতি আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে বিপর্যয় নেমে এসেছে ভ্যাট আদায়ে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাসে অর্থাৎ আগস্ট মাসে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। আর সাময়িক হিসেবে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৭ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। শুধু আগস্ট মাসেই ভ্যাট আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে এনবিআরের গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ২০ দশমিক ০৪ শতাংশ, আয়কর খাতে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সেখানে রাজস্ব আহরণের প্রধান খাতের অবস্থা খুবই খারাপ। আলোচ্য সময়ে ভ্যাট আদায়ের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক অর্থাৎ মাইনাস ২ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

এনবিআরের ভ্যাট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ভ্যাট আদায়ের একটা বড় অংশ আসে সরকারি প্রকল্প এবং অন্যান্য খাত থেকে। ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে ডলার নির্ভর সরকারি প্রকল্প আপাতত বন্ধ রয়েছে। এতে উৎসে কর উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে। এছাড়া বিভিন্ন পণ্যে আবশ্যকীয় পণ্যের দাম নাগালের মধ্যে রাখতে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ভোজ্য তেল এবং সর্বশেষ জ¦ালানি তেলের উপর ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এর একটা প্রভাব পড়েছে সার্বিক ভ্যাট আদায়ে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশনার সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, ভ্যাট আদায়ের তিন ভাগের এক ভাগ আসে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প এবং খাত থেকে। এবার প্রকল্প অন্য বছরের তুলনায় কমে যাওয়ার একটা প্রভাব পড়েছে ভ্যাট আদায়ে। সেই সঙ্গে ভোজ্য তেল থেকে শুরু করে চালসহ বেশ কিছু পণ্যে নতুন করে ভ্যাট অব্যহতি দেয়া হয়েছে। এতে সার্বিক ভ্যাট আদায় কমেছে। তবে মূল্যস্ফীতি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে যেসব সুবিধা ভ্যাটে পাওয়ার কথা, আমরা সেটা পাচ্ছি। তাই ভ্যাট আদায় পরিস্থিতি এখনো ভালো রয়েছে বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ডলার সংকটের কারণে সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণ করেছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ডলারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন প্রকল্পগুলোকে সি ক্যটাগরি ধরে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্তমানে সি ক্যাটাগরির প্রকল্পের সংখ্যা ৮১টি। আর বি ক্যাটগরিতে আরো ৬০০ প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে এ ক্যাটাগরিতে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৬শ প্রকল্প। শুধু এ ক্যাটাগরির প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হবে। পরিকল্পনা কমিশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় ১০টি প্রকল্প রয়েছে। তবে নতুন প্রকল্পের চেয়ে পুরনো প্রকল্পে জোর দেয়া হচ্ছে বলেও নিশ্চিত করেছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা।

সারাদেশের ভ্যাট কমিশনারেটগুলোর আগস্ট মাসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনস্থ ১২ কমিশনারেটের কোনো কমিশনারেটই এনবিআরের ভ্যাট আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। ভ্যাট কমিশনারেটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভ্যাট আদায় করে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)। এলটিউর অধীনে দেশের সব বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিবন্ধিত। আগস্ট মাসে এলটিইউর ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এলটিউর ভ্যাট আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬৩ কোটি টাকা। ভ্যাট কমিশনারেট চট্টগ্রামের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৩৭ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৬০৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ চট্টগ্রাম ভ্যাটে ঘাটতি ২২৯ কোটি টাকা। ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেটের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮২৫ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৭৯৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ শুধু আগস্ট মাসে ভ্যাট আদায়ে ঘাটতি ৩০ কোটি টাকা। বেহাল অবস্থা ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে। আলোচ্য সময়ে উত্তরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৭১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ উত্তর কমিশনারেটে ঘাটতি ২৯৭ কোটি টাকা। রাজশাহী ভ্যাট কমিশনারেটের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫৪ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৫৭ কোটি টাকা। এতে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ কোটি টাকা। যশোর কমিশনারেটের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫৯ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৯০ কোটি টাকা। এতে ঘাটতি তৈরি হয়েছে ৬৯ কোটি টাকার। আগস্ট মাসে খুলনা ভ্যাট কমিশনারেটের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০৭ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ১৬২ কোটি টাকা, ঘাটতি ৪৪ কোটি টাকা। সিলেট ভ্যাট কমিশনারেটের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৮ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা, ঘাটতি ৩২ কোটি টাকা। ঢাকা পূর্ব কমিশনারেটের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০৭ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ২৭৩ কোটি টাকা, ঘাটতি ৩৩ কোটি টাকা। ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কমিশনারেটের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০২ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ২১১ কোটি টাকা, ঘাটতি ৯১ কোটি টাকা। কুমিল্লা ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩৮ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ২০১ কোটি টাকা, ঘাটতি ৩৬ কোটি টাকা। এছাড়া রংপুর ভ্যাট কমিশনারেটের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০৩ কোটি টাকা, ভ্যাট আদায় হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ কুমিল্লা ভ্যাটেও ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ কোটি টাকা।

এনবিআর সূত্র জানায়, সরকারি প্রকল্পের উৎসে কর ছাড়া ভ্যাটের আরেকটি বড় স্টেকহোল্ডার টোবাকো কোম্পানিগুলো। চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এক্ষেত্রে বেশি রাজস্ব পাওয়া যাবে এই ধরনের কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। আগের থেকে একটু বাড়ানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, একটি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে অন্যদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সার্বিক ভ্যাট আদায়ে। এছাড়া নিত্যপণ্যের দাম বিশেষ করে ভোজ্য তেল আমদানিতে দফায় দফায় ভ্যাট কমানো হয়েছে। সেই সঙ্গে জ¦ালানি তেল এবং চালেও ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এতে ভ্যাট আহরণে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এছাড়াও ভ্যাট কমিশনারেটগুলোর নজরদারির অভাব রয়েছে। তুলনামূলক দুর্বল কাঠামো দিয়ে ভ্যাট প্রশাসন চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের ভ্যাট আদায়ে শ্লথ গতি দেখা যাচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে ভ্যাট আহরণে ব্যর্থ হচ্ছেন কর্মকর্তারা। এছাড়া বৈশ্বিক অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। রাতারাতি আমদানি পণ্যের দাম দিগুণ থেকে তিনগুণ বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ পণ্যের দামও উর্ধমুখী। যার প্রভাব পড়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। সংসারের খরচ মেটাতে খাবারের তালিকা কাটছাঁট করছেন মধ্যবিত্তরা। এর প্রভাব পড়েছে সার্বিক ভ্যাট আদায়ে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি বাড়লে ভ্যাট আদায় বাড়বে- এটা খুবই স্বাভাবিক নিয়ম। এছাড়া ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানি-রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু এর প্রভাব ভ্যাট আদায়ে পড়ছে না। উল্টো কমছে ভ্যাট আদায়। এক্ষেত্রে হয়ত মানুষ কেনাকাটা কম করছেন যার প্রভাব পড়ছে ভ্যাট আদায়ে। এছাড়া ভ্যাট আদায়ে ইএফডি বসানো থেকে থেকে শুরু করে মাঠ প্রসাশনের একটা দুর্বলতা তো রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com