এফবিডি ডেস্ক॥
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়ে মুদ্রানীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। পাশাপাশি বিদ্যমান দেশীয় ও বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব মোকাবিলায় চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বিবি)। আগামী জানুয়ারির শেষ দিকে চলতি অর্থবছরের জন্য দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে সংশোধন আনা হবে। এ লক্ষ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে। এর মধ্যে কিছু খাতে ঋণের সুদের হার আরও বাড়ানো হবে। নীতি সহায়তায়ও পরিবর্তন আনা হবে।
বিদ্যমান সংকট মোকাবিলার কৌশল নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত সোমবার দেশের অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। সেখানে অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়ে মুদ্রানীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে বলেছেন। একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে তারল্য বাড়ানোরও পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। দুটি পরস্পরবিরোধী হলেও ব্যাংকিং খাতের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা ধরে রাখতে তারল্য বাড়াতে হবে। এছাড়া মুদ্রানীতি ও এর উপকরণগুলোর ব্যবহারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করার কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই), সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) শীর্ষ পর্যায়ের অর্থনীতিবিদরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বৈঠকে বলা হয়েছে, মুদ্রানীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, ব্যাংক খাতে তারল্য স্বাভাবিক রাখা ও ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলো একটির সঙ্গে অপরটি সম্পর্কিত ও পরস্পর বিরোধী। তারল্য বাড়ালে মূল্যস্ফীতির হার বাড়বে। আবার তারল্য না বাড়ালে ব্যাংক খাতে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে। এসব বিষয়ে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে মুদ্রানীতির কাজ করতে হচ্ছে। এ খাতে সমন্বয় আনাই এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এ প্রসঙ্গে পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রাধান্য দিতে হবে। তার মধ্যে আবার ব্যাংকে তারল্য প্রবাহও বাড়াতে হবে। এ দুটি কাজই বড় চ্যালেঞ্জিং। একটি করলে আরেকটি বাড়বে।
তিনি বলেন, বৈঠকে তারা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সংস্কার দ্রুত করা, খেলাপি ঋণ কমানো, মুদ্রানীতির উপকরণগুলো সঠিকভাবে ব্যবহারের সুপারিশ করেছেন।
গভর্নর এগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
বৈঠকে বলা হয়, দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে আসছে। এর মাধ্যমে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানোর নীতি গ্রহণ করা হলেও সেগুলো খুব বেশি কাজ করছে না। তবে গত আগস্টের তুলনায় নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে। সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে গিয়ে ব্যাংকে তারল্যে কিছুটা টান পড়েছে। তারল্য বাড়াতে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার জোগান বাড়াচ্ছে। তারল্য কমার কারণ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, রেমিট্যান্স কমা, আমানত প্রবাহের গতি হ্রাস ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কেনার কারণে ব্যাংকে তারল্য কমেছে। এখন তারল্য বাড়াতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অর্থ বা বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ করা অর্থ ছাড়তে হচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়বে। আবার তারল্য সরবরাহ কমে গেলে ব্যাংকগুলো স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে পারবে না। ফলে এখানে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
এদিকে ডলারের বাজারে সংকট এখনো বিদ্যমান রয়েছে। তবে জানুয়ারি থেকে এ সংকট কমতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে। কারণ দেশে কৃষির ফলন ভালো হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। এর সুফল জানুয়ারি থেকে পাওয়া যেতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা আর বলেছেন, মুদ্রানীতির উপকরণগুলোকে আরও সতর্কভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খুব বেশি কিছু করণীয় না থাকলেও মানুষের প্রত্যাশা রয়েছে তারা এ হার নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তাদের স্বস্তি দেবে।
বিনিময় হারের ক্ষেত্রে তারা সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। এ জন্য হুন্ডি কমাতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সরকারের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দেন।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) মুদ্রানীতিতে সংস্কার আনার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা আগের মতো বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রস্তাব করেছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফের আরও একটি শর্তের বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।
তবে গত জুনে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল ছয় মাস পর বিদ্যমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন আনা হবে।