বিশেষ প্রতিনিধি॥
ঈদের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নন-এসি বাসগুলো বাড়তি ভাড়া হিসেবে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেশি আদায় করছে। অপরদিকে এসি বাসের ভাড়া আরও বেশী নেয়া হচ্ছে বলে যাত্রীরা অভিযোগ করছে। এতে করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে সরকারের সকল উদ্যোগ এক অর্থে ব্যর্থই হচ্ছে বলে ধারণা করছেন অভিজ্ঞমহল।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুসারে, ঈদকে সামনে রেখে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়েছে। আবার সমপরিমাণ মানুষ বিভিন্ন স্থান থেকে রাজধানীতে ফিরবেন। এরমধ্যে একটি বড় অংশই রয়েছে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার।
বগুড়ার ঠনঠনিয়া বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষমান চাকরিজীবী আমজাদ হোসেন বলেন, তিনি ১৬০০ টাকা দিয়ে এসআর পরিবহনের একটি গাড়ির টিকিট কিনেছেন। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া তাকে গুনতে হয়েছে।
এছাড়া সিরাজগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে এস আই পরিবহনের টিকিট কিনেছেন ব্যবসায়ী আরিফুল ইসলাম। তিনি আগামী ৮ এপ্রিল স্ব পরিবারে সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকা যাবেন। প্রতিটি টিকিটের জন্য তাকে অতিরিক্ত ১৫০ টাকা করে দিতে হয়েছে। অথচ, আগে প্রতিটি টিকেটের মুল্য ছিল ৩৫০ টাকা। বাস কর্তৃপক্ষ এখন টিকেট প্রতি ৫০০ টাকা করে আদায় করছেন। এতে আরিফের ৪ টি টিকেটে মোট ৬০০ টাকা অতিরিক্ত প্রদাণ করতে হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, সহজ ডট কম থেকে যারা অনলাইনে টিকিট কাটছেন তাদেরকেও বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। গাইবান্ধায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে আলহামারা পরিবহনের এসি কোচের টিকিটের দাম রাখা হচ্ছে ২ হাজার টাকা। অথচ সাধারণ সময় এই টিকিটের দাম নেওয়া হত ৯শত থেকে ১ হাজার টাকা।
পঞ্চগড় থেকে ঢাকাগামী হানিফ এন্টারপ্রাইজের এসি কোচের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। সাধারণ সময় এই ভাড়া ২ হাজার করে নেওয়া হত।
হানিফ এন্টারপ্রাইজের জেনারেল ম্যানেজার মোশাররফ হোসেন বলেন, অন্যান্য বাস অপারেটরদের মতো আমরাও ভাড়া বাড়িয়েছি। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ ও ঈদকে ঘিরে রাস্তায় যানজটের কারণে আমাদের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে হচ্ছে। এসি-নন এসি সব ধরনের বাসেই ভাড়া বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবু রায়হান বলেন, “আমরা সরকার নির্ধারিত ভাড়াই নিচ্ছি। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ সত্য নয়। ঈদের সময় গাড়িগুলোকে ঢাকায় ফাঁকা ফিরতে হয়, তাই কেউ কেউ বাড়তি ভাড়া নিয়ে থাকতে পারে। এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিরা জ্ঞাত আছেন।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর বলেন, “ঈদের আগের দুই দিনে প্রতিদিন গড়ে ২৫ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ে। আবার প্রায় সমপরিমাণ মানুষ বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজধানী ঢাকার অভিমুখে রওনা হয়। অথচ দেশের মূল গণপরিবহন বাস, ট্রেন ও লঞ্চে দিনে যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা আছে সাড়ে ১০ লাখের মতো। চাহিদা ও যোগানের এই বিরাট পার্থক্যের কারণে দুই-চার দিন ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলে। এবার পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটি আগে থেকেই শুরু হওয়ায় এখন কিছুটা নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। পরিবহন স্বল্পতার অযুহাতে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের কাছে থেকে।”
উল্লেখ্য, উত্তরাঞ্চলের মানুষের মূল যাতায়াত বাসে। গত ঈদুল ফিতরে দূরপাল্লার পথে বিপুল যাত্রী ঝুঁকি নিয়ে মোটরসাইকেলে বাড়ি গেছেন। এবার সরকার ঈদে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে। এ সুযোগে বাস মালিক-শ্রমিকেরা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ভয়ংকর ব্যাপার হলো সাধারণ মানের বাসে শুধু এসি লাগিয়ে দ্বিগুণের বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জের নিউ ঢাকা রোডের এসআই কাউন্টার, অভি কাউন্টার, জেনিন কাউন্টার, সিরাজগঞ্জ লাইন কাউন্টার এবং বগুড়ার বানানী, ঠনঠনিয়া ও চারমাথা বাস টার্মিনালের বিভিন্ন কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সবগুলো বাসেই নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে নানা অজুহাতে। কোন কোন ক্ষেত্রে বাসগুলোতে মোড়া দিয়ে, চালকের পাশে গাদাগাদি করে বসিয়ে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলগামী বাসগুলোতেও একই ভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে পুলিশ প্রসাশনের সামনেই। অথচ, সবাই নির্বিকার, নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, “বাড়তি ভাড়া যাতে আদায় না হয়, সেজন্য আমরা লোক নামিয়েছি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পরিবহন সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার এসি বাসের ভাড়া ঠিক করে দেয় না। এজন্য পরিবহন মালিকরা ইচ্ছামতো ভাড়া নির্ধারণ করেন। আবার বড় কোম্পানির বাইরে অন্যান্য পরিবহন অগ্রীম টিকিট বিক্রি করে না। যাত্রার আগে আগে যাত্রীদের কাছ থেকে কর্মীরা ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে।
পরিবহন খাতের সূত্রগুলো জানায়, ঈদ উপলক্ষে বড় কিছু পরিবহন কোম্পানি অগ্রীম টিকিট বিক্রি করে। সেই টিকিট ছাড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত একটি চক্র এই টিকিটের একটা অংশ কিনে রাখে। শেষ দিকে তারা চড়া দামে এসব টিকিট কালোবাজারে বিক্রি করে।
সিরাজগঞ্জের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মো: জাফরুল্লাহ বলেন, “ঈদকে ঘিরে সড়ক ও মহাসড়কের সকল প্রকার নৈরাজ্য প্রতিরোধ কল্পে সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপারের নির্দেশ ও সহযোগীতায় ট্রাফিক বিভাগ ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। আমরা আশা করি বিগত বছরের চেয়ে এবছর ঈদে ঘরমুখি মানুষ অনেক বেশী আরমে এবং নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে। এর পরেও যদি কোথাও কোন অসঙ্গতির খবর পাওয়া যায, আমরা দৃঢ় হস্তে তা প্রতিরোধ করবো।”