এফবিডি ডেস্ক॥
বর্তমান বাজার দরে চার সদস্যের একটি পরিবারে মাছ-মাংস ছাড়াই খাবারের জন্য খরচ হচ্ছে ৯ হাজার ৫৫৭ টাকা। মাছ-মাংস ধরলে খাবারের এ খরচ দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকায়। আটটি খাত ছাড়া অন্য কোনো খাতের কর্মীর এই ব্যয় বহন করার সক্ষমতা নেই।
শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইন অডিটোরিয়ামে ‘সংকটে অর্থনীতি : কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে?’ শীর্ষক সংলাপে উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মজুরি পর্যালোচনার সর্বশেষ বছর থেকে মূল বেতনের ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলেও সমস্ত শিল্পের শ্রমিকদের জন্য চার সদস্যের একটি পরিবারের খাদ্যের এই খরচ বহন করার সক্ষমতা তৈরি হবে না।
সংলাপে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান প্রধান অতিথি এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
সংলাপে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান হাবিব মনসুর, বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এবং বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক রূপালী হক চৌধুরী।
ড. ফাহমিদা তার প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি যে অবস্থায় ছিল সেখান থেকে আরও ঘনীভূত হয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বড় কারণ হলেও আগে থেকেই মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারের পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা বড় কারণ। এর ফলে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। আগে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়লে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কমত। কিন্তু এখন দুটোই সমানতালে বেড়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তুলনা করলেও অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই মূল্যের ঊর্ধ্বগতি বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে চাল, গম, ভোজ্য তেল, চিনি কিংবা গরুর মাংসের মূল্যের ক্ষেত্রে এমন প্রবণতা রয়েছে। অর্থাৎ, খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি হারে বাড়ছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের দাম আগে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। তবে এখন সেই জায়গাতেও অস্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মুদ্রার বিনিময় হার, রিজার্ভ ব্যবহারের দুর্বলতা, ট্রেড ইনভয়েসিংয়ের কারণে অর্থ পাচার ইত্যাদি। এসব কারণে এক ধরনের ভঙ্গুরতা লক্ষ করা গেছে।
রিজার্ভের বিষয়ে সিপিডি বলছে, রিজার্ভের হিসাব নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। রিজার্ভের কারণে এলসি খোলা কিংবা আমদানির ক্ষেত্রে চাপ তৈরি হয়েছে। রপ্তানি বাড়লেও কারেন্ট হিসাবে ব্যালেন্স নেতিবাচক। রেমিটেন্স প্রবাহ কমে এসেছে। বিদেশে মানুষ যাওয়ার প্রবণতা বাড়লেও রেমিটেন্স বাড়ছে না। এখানে হুন্ডি মার্কেট বিরাটভাবে প্রভাবিত করছে। সরকারের আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা থাকা সত্ত্বেও রেমিটেন্স বাড়ছে না। এটা একটি চিন্তার বিষয়। বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগের কারণে অপ্রয়োজনীয় এলসি খোলার প্রবণতা কমেছে।
সংলাপে ড. ফাহমিদা বলেন, ‘আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দেখতে পারছি, এনবিআরের রাজস্ব আয় বেড়েছে। পরোক্ষ কর অর্থাৎ আমদানি বৃদ্ধির কারণে এ আয় বেড়েছে। এডিপি বাস্তবায়নের হার গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম দেখা যাচ্ছে, যা ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া এর বড় কারণ বলে দেখা যাচ্ছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে প্রথম চার মাসে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে অর্থ নেওয়ার হার বেড়ে যাচ্ছে ও সঞ্চয় কমে যাচ্ছে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘আমাদের ঘাটতি আছে স্বীকার করছি। কোভিডের মধ্যেও আমাদের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি ছিল। আমাদের অনেক জায়গায় আমরা ইমপ্রুভ করার চেষ্টা করছি। এখন আর ১০ বছরে জনশুমারি হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অর্থনীতি চালাচ্ছি জেনেশুনেই।’
সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অর্থনীতির মূল সংকটের একটি হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বলতা। তারা বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করে, অথচ ভারতের মতো রাষ্ট্রে চার বার মুদ্রানীতি ঘোষিত হয়। এটা তো বাজেট না যে, বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন।’
তিনি বলেন, ‘দেশের আর্থিক খাতে মূলত স্বচ্ছতার অভাব। ডাটা পাওয়া কোনো ব্যাপারই না। কয়েক বছর আগে ব্যাংক খাত সংস্কার করা হলো, কিন্তু দেখা গেলো এটা উল্টো রথে গেল। তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন কারেন্ট অ্যাকাউন্ট কিভাবে বাড়ল, তারা কোথায় এ বিনিয়োগ বাড়াল?’
ড. আহসান হাবিব মনসুর বলেন, ‘ঝড়ের আগে পরিবেশ খুব ঠাণ্ডা থাকে। কিন্তু যখন প্রলয় এসে যায় করার কিছু থাকে না। দেশের অর্থনীতিরও একই অবস্থা। ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও ক্রমান্বয়ে কমছে। কিন্তু ভারতের মতো রাষ্ট্রে তা ১৯ থেকে ২০ শতাংশ। তাদের ক্যাপাসিটি টু অ্যাবজর্ব আর আমাদের ক্যাপাসিটি টু অ্যাবজর্ব কি এক হলো?’
তিনি বলেন, ‘জানুয়ারির মধ্যে ডলার সংকট কেটে যাবে, আমি বলি আগামী ছয় মাসেও ডলার সংকট কাটবে না। আরও বেশি সময় লাগতে পারে। ব্যাংকে সংকট এত প্রকট যে, অল্প কয়েকদিনে ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, এটা তো তলাবিহীন বাস্কেটের মতো। রিজার্ভের হিসেবে কোনো আন্তর্জাতিক নিয়ম নাই। রেগুলটরি সংস্থা কিছুই করব টাইপের ভাব নিয়ে বসে আছে। সরকারকে ধন্যবাদ আইএমএফের সঙ্গে খুব দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে।’
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির সংকটে মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি একসঙ্গে দেখলে হবে না। দুটোকে আলাদা করে দেখুন। দেশের আমদানি ব্যয় বেড়েছে দুটো কারণে- একটি আন্তর্জাতিক, আরেকটি অভ্যন্তরীণ বাজারের অনিয়ম। সাপ্লাই বাড়লে দেশের মূল্যস্ফীতি কমতে সাহায্য করবে। মিনিমাম ওয়েজ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির সমাধান সম্ভব না। আইএমএফের কাছ থেকে সঠিক পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত কি জানি না, পরামর্শগুলো সবাই জানি। কারণ তাদের পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হলে আইএমএফ অর্থ ছাড় করে না।’
এ সময় অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘সাবসিডি যদি দিতেই হয় পুঁজিবাজারে দেন। গ্রামীণফোনের মতো কোম্পানির বিরুদ্ধে সরকার এমনভাবে সিদ্ধান্ত নিল, ফলে তার দাম এত কমে গেছে যে, বিনিয়োগকারীদের মাথায় হাত। আর বিএসইসির ফ্লোর প্রাইস দিয়ে তো পুঁজিবাজার চালানো যায় না।’