রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৮ অপরাহ্ন

ডোপ টেস্টে শুভঙ্করের ফাঁকি

  • আপডেট সময় শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১১.৫৭ এএম
  • ২৭ বার পড়া হয়েছে

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি॥

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পেশাদার চালকদের জন্য নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু এবং মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নবায়নে ডোপ টেস্ট বা মাদক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সারা দেশের মতো কুষ্টিয়া জেলায়ও শুরু হয়েছে এই পরীক্ষা। তবে শুধুমাত্র প্রস্রাবের নমুনার ডোপ টেস্ট পদ্ধতিতে স্বাস্থ্য বিভাগ প্রকৃত মাদকসেবীদের চিহ্নিত করতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। কারণ শুধু মাদক গ্রহণ ও পরীক্ষার সময়ের হেরফের করতে পারলেই এই পদ্ধতির ডোপ টেস্টকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

বিদ্যমান এই পদ্ধতিতে কোনো ব্যক্তি সর্বশেষ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মাদক গ্রহণ না করলে মাদকসেবী নন বলে চিহ্নিত হচ্ছে। আর এই সুযোগে নিয়মিত মাদকসেবীরাও শুধুমাত্র ডোপ টেস্টের আগের তিন দিন মাদক সেবন থেকে বিরত থেকে পরীক্ষায় উতরে যাচ্ছেন। জেলার পরিবহন মালিক সমিতির একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে এই অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে রক্ত, চুল বা নখ পরীক্ষাসহ বিকল্প অন্য পদ্ধতিগুলো প্রয়োগের তাগিদ দিয়েছেন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা। তবে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, সরকার নির্দেশিত পদ্ধতির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই তাদের।

এদিকে গত ১৫ জুন শুরুর পর কিট সংকটে গত ৩ আগস্ট থেকে কুষ্টিয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে পেশাদার গাড়িচালকদের জন্য বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্ট। ফলে নতুন লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়ন করতে পারছেন না গাড়িচালকরা। জেলা বিআরটিএ ও কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, টেস্ট কিট ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে ডোপ টেস্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে লাইসেন্স না পাওয়া বা নবায়ন করতে না পারায় হয়রানি হতে হচ্ছে প্রায় ৩ হাজার গাড়িচালককে।

 

জানা গেছে, নতুন লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নের জন্য লাইসেন্সপ্রতি ৯০০ টাকা জমা সাপেক্ষে গত ২২ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ২২০ জন আবেদনকারীর আবেদন ডোপ টেস্টের জন্য কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে পাঠায় কুষ্টিয়া বিআরটিএ। এর মধ্যে ৯৬৫ জনের ডোপ টেস্টের ফলাফল পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ১৫ জনের রিপোর্ট পজিটিভ আসায় তাদের লাইসেন্স ইস্যু স্থগিত করা হয়। এখনো ডোপ টেস্টের অপেক্ষায় আছেন ২ হাজার ২৫৫ জন।

তবে এই ডোপ টেস্টের সুফল নিয়ে সংশয়ে জেলার পরিবহন মালিকরা। সংগঠনের ভোটের রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুষ্টিয়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের এক সাংগঠনিক সম্পাদক হাসতে হাসতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার থাকে ডালে ডালে, আর শ্রমিকরা থাকে পাতায় পাতায়। মাদকমুক্ত চালক বাছাইয়ে সরকারের ডোপ টেস্ট পদ্ধতি আমরা সমর্থন করি, তবে যে পদ্ধতিতে ডোপ টেস্ট হচ্ছে তা যথাযথ নয়। গত দুই মাসে নতুন-পুরনোসহ পাঁচ শতাধিক ড্রাইভার লাইসেন্স পেয়েছেন। তার মধ্যে ৭০ শতাংশ বা ৩৫০ চালকই মাদকাসক্ত। অথচ ডোপ টেস্ট করে তাদের দেহে কোনো মাদক পায়নি বলে ডাক্তার রিপোর্ট দিয়েছে। তাহলে নিশ্চয় এই পরীক্ষার মধ্যে কোনো ত্রুটি আছে। ডাক্তাররাই ভালো বলতে পারবেন সমস্যাটা কী?’

প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়ে শুধু প্রস্রাবের নমুনার বদলে রক্ত বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে ডোপ টেস্ট করার দাবি জানিয়েছেন কুষ্টিয়ার বাসিন্দা এবং সামাজিক সংগঠন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কারশেদ আলম। তিনি বলেন, ‘যে পরীক্ষায় যথাযথ ফল মেলে না তা করা সরকারি অর্থ ও জনবলের অপচয় ছাড়া আর কিছুই না।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কেউ এক হাজার ন্যানোগ্রামের বেশি এমফিটামিন বা ইয়াবা সেবনের তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ডোপ টেস্ট করালেই কেবল তার রিপোর্ট পজিটিভ আসবে। নির্দিষ্ট এই সময়ের মধ্যে এক হাজার ন্যানোগ্রামের কম ইয়াবা সেবন করলে ডোপ টেস্টেও ধরা পড়বে না। আবার সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে এই সময়ের মধ্যে ডোপ টেস্ট না করালে বা তিনি ওই সময়ে মাদক গ্রহণ না করলে মাদকসেবী প্রমাণের সুযোগ খুবই কম।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সাধারণত এখন যাদের ডোপ টেস্ট করা হয়, তাদের নির্দিষ্ট সময়ে ল্যাবে হাজির হতে বলা হয়; যা সময়সাপেক্ষ। এতে একজন মাদকসেবী গাঁজা ছাড়া অন্যসব মাদক সেবন বন্ধ করলে তাদের শনাক্তের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলে বিদ্যমান পদ্ধতিতে ডোপ টেস্ট করলে সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত দেশের মানদণ্ড মেনে আধুনিক পদ্ধতিতে চুল, লোম, নখ থেকে নমুনা সংগ্রহ করলে সেবনকারীর শরীরে এক মাসের বেশি সময় ইয়াবা এবং তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত গাঁজার অস্তিত্ব পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া বর্তমান পদ্ধতিতে যথাযথ ফল পেতে হলে সন্দেহভাজনদের বুঝে ওঠার আগেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডোপ টেস্টের আওতায় আনা উচিত।

তারা আরও বলেন, ইয়াবার মতোই এক হাজার ন্যানোগ্রামের বেশি হেরোইন, মরফিন, কোডিন গ্রহণের তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ডোপ টেস্ট করলে পজিটিভ রিপোর্ট আসবে। গাঁজা বা ভাং সেবনের তিন থেকে ত্রিশ দিনের মধ্যে তা ধরা পড়বে। তবে মদ বা অ্যালকোহলজাতীয় দ্রব্য সেবনের ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পর শনাক্তের সম্ভাবনা কম। কারণ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মদ বা অ্যালকোহলের উপাদান শরীর থেকে বিনষ্ট হয়। এ জন্য উন্নত বিশ্বে এবং বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোয় ব্রেথ এনালাইজার ব্যবহার করা হয়। তবে এই যন্ত্র মাদক পরীক্ষাসংশ্লিষ্টদের কাছে সহজলভ্য নয়। ফলে সরকার ডোপ টেস্টে জোর দিলেও পরীক্ষায় জটিলতা রয়েই গেছে।

বিদ্যমান পদ্ধতিতে ডোপ টেস্টে যথাযথ ফলাফল না পাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবদুল মোমেন বলেন, ‘এখান থেকে যে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে তা সঠিক। তবে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের দেহে মাদক পাওয়া যায়নি বলে যে অভিযোগ আপনারা দিচ্ছেন সেটা হতে পারে এমন যে, এখানে স্যাম্পল দিতে আসা চালকরা ৭২ ঘণ্টা আগে থেকে কোনো মাদক দেহে না ঢোকালে কেবলমাত্র তার প্রস্রাব টেস্ট করে কোনো মাদকের উপস্থিতি নাও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সরকারি নিয়মের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ আমাদের নেই।’

প্রস্রাবের নমুনার বাইরে আর কী পদ্ধতিতে মাদকাসক্ত শনাক্ত করা যেতে পারে জানতে চাইলে ঝিনাইদহ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তাপস কুমার সরকার বলেন, ‘বিদ্যমান পদ্ধতিতে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে ডোপ টেস্টের কার্যক্রম চলছে। তবে এই পরীক্ষা নিয়ে কোনো সন্দেহ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে রক্তের সেরাম টেস্টের মাধ্যমে মানবদেহে মাদকের উপস্থিতি আছে কি নেই সেটা নির্ণয় করা সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে বিদ্যমান পদ্ধতি থেকে আরও অনেক বেশি খরচ হবে।’

কিট সংকটে ডোপ টেস্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কুষ্টিয়া বাস মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি মো. নূরুল ইসলাম বলেন, ‘ডোপ টেস্ট জটিলতা চালকদের নানা ভোগান্তির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ওরা লাইসেন্স পাওয়ার জন্য পথে পথে ঘুরছে। মামলার ভয়ে আন্তঃজেলা পরিবহন চালকরা ভাড়ায় যেতে চাচ্ছে না। আমরা এখন ড্রাইভার সংকটে পড়েছি।’

এ প্রসঙ্গে বিআরটিএ কুষ্টিয়া জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আতিকুল আলম বলেন, ‘গত ২৪ জুলাই কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয় থেকে চিঠি দিয়ে টেস্ট কিট ফুরিয়ে যাওয়ার তথ্য জানানো হয়েছে। এদিকে প্রতিদিন ৫০/৬০ জন লাইসেন্সপ্রত্যাশীকে ডোপ টেস্টের জন্য পাঠানো হচ্ছে। ডোপ টেস্ট জটিলতায় লাইসেন্স প্রদান কার্যক্রম আটকে যাচ্ছে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবদুল মোমেন বলেন, ‘আবার কিট এলে পরীক্ষা শুরু হবে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। দ্রুতই কিট চলে আসবে বলে আশা করছি।’

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com