নিউজ ডেস্ক॥
তেজগাঁওয়ের একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন সাব্বির। পুরো নাম মনোয়ার হোসেন সাব্বির। অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে হাতিরঝিল মধুবাগ ব্রিজের উপর কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তার সংসার। ২৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে হাতিরঝিলের পাশেই মীরবাগে কম ভাড়ার বাসায় থাকেন তিনি। এ টাকার মধ্যে ১০ হাজার টাকা বাসাভাড়া। পানির বিল ৫০০, গ্যাস ৯৭৫, ডিশ বিল ৪০০, ইন্টারনেট ৫০০, বিদ্যুৎ গড়ে ৮০০, ময়লা ফেলার জন্য ১২৫, মাসিক ডিপিএস কিস্তি ১ হাজার, বাড়িতে থাকা মায়ের ওষুধ ৫৫০, ছোট দুই সন্তানের লেখাপড়া বাবদ ৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ২০ হাজার টাকার উপরে খরচ। বাকি টাকা দিয়ে কোনো রকমে সারা মাসের চাল, ডাল, তেল, আটা ও কাঁচাবাজার কিনতে হয়। মাছ-মাংসের কথা চিন্তাই করা যায় না।
বেশির ভাগ দিন হেঁটেই অফিস যাতায়াত করেন তিনি। এ ভাবে কৃচ্ছ্রতা করেও প্রতি মাসেই সংসারের বাজেটে ঘাটতিতে পড়ে যান বলে জানান তিনি। সাব্বির জানান, আগে প্রত্যেক মাসের জন্য যে টাকা খরচ হতো নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পর ওই একই বাজার এখন ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা বাড়তি লাগছে। এই টাকা কোথা থেকে আসবে? বেতন তো বাড়েনি। সমানভাবে বেড়েছে অন্যান্য ব্যয়ও।
ফলে এখন কম বাড়ার বাসায় থাকাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে তার জন্য। তার মতে, এভাবে সংসার চালানো সম্ভব নয়। এমনিতেই সংসার চালাতে হিমশিম খেতাম। সব কিছুর ব্যয় বাড়ায় এখন টিকে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে। কোনো দিন টিসিবি’র পণ্য কিনি নাই। এখন কিনতে বাধ্য হচ্ছি। আগে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাস টেনেটুনে চলতো। এখন খরচ কমিয়েও টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু সাব্বির নন, গত কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্য এত বেড়েছে যে, তা অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এর আগে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ার পর মহামারির প্রভাবে অনেকেরই আয় কমে গেছে। সেই ধাক্কাই এখনো কেউ সামলে উঠতে পারেননি। এর মধ্যে তেল, চাল, ডাল, মাছ, মুরগি, ডিম, চিনি ইত্যাদির পাশাপাশি সাবান, টুথপেস্ট, প্রসাধনীর মতো নানাবিধ গৃহস্থালি পণ্যের দাম লাগামহীন বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজের বেতন ও খাতা-কলমের মতো স্টেশনারি পণ্যের দামও বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্যতালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২০ সালের পর গত দুই বছরে মোটা চাল ৩৫ শতাংশের বেশি, সরু চাল ২৮, মোটা দানার মসুর ডাল ৬৩, চিনি ৩২, বোতলজাত সয়াবিন তেল ৫৫, খোলা সয়াবিন তেলের দাম ৮৩ শতাংশ বেড়েছে।
এর মধ্যে সরকার নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কর কমালেও কোনো কাজে আসেনি। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে জীবিকা। রাজধানীর নাখালপাড়ার একটি মেসে থাকেন আফজাল করিম। তার সঙ্গে কথা হলে জানান, ২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন বেসরকারি কোম্পানিতে। অর্ধেক টাকা গ্রামের বাড়ির অসুস্থ পিতামাতার জন্য পাঠাতে হয়। বাকি টাকা ঢাকায় বাসাভাড়া-খাবারের পেছনে ব্যয় করেন তিনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিয়েও করতে পারছেন না। আবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামের বাড়িতে আরও বেশি টাকা পাঠাতে হচ্ছে। বাকি টাকা দিয়ে ঢাকায় চলাও সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম বাজারে তো আগুন, আমাদের তো সব জিনিস আগের তুলনায় দুই গুণ দামে কিনতে হচ্ছে। তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি এলাকায় দুপুরে রুটি-কলা খাচ্ছিলেন অনলাইনে অর্ডার পাওয়া পণ্য সরবরাহ কর্মী পারভেজ। দুপুরে ভাত না খেয়ে রুটি-কলা খাচ্ছেন কেন? জবাবে তিনি বলেন, সাধারণ কোনো হোটেলে এক বেলা সবজি, ডাল ও ভাত খেতেও ১০০ টাকার বেশি চলে যায়। তাই টাকা বাঁচাতে সম্প্রতি রুটি-কলা খেয়ে কাটানো শুরু করছি।
তিনি বলেন, বাসাভাড়া বেড়েছে। চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ৫০০০ টাকার স্থলে ৮০০০ হাজার টাকা লাগছে। অফিসে যাওয়া-আসা করতেও বাসভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে। কিন্তু আমার তো আয় এক বছর আগে যা ছিল, এখনো তা-ই আছে। ফলে সংসারের অনেক প্রয়োজনীয় খরচ কমাতে হয়েছে। এ ছাড়া ছোটখাটো রোগে ওষুধ কেনাও বন্ধ করেছি। তবুও ধার-কর্জ করে সংসার চালাতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি, গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি, চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যয় বেড়েছে লাগামহীন। ভোজ্য তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে অস্থির করে তুলেছে। সে তুলনায় আয় বাড়েনি। উল্টো কিছু ক্ষেত্রে আয় কমেছে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় কারণে অকারণে। কোনো একটি অজুহাত পেলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যায়। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তার মতে, সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থার প্রবর্তন করলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার স্থায়ী সমাধান পাওয়া যেতে পারে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বমুখিতা ঠেকাতে বাজার মনিটরিং জোরদার করার পাশাপাশি খাদ্যে ভর্তুকি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। (সোর্স: মানবজমিন)