সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৫ পূর্বাহ্ন

শেয়ারবাজারের হালচাল: আইন প্রণয়ন, পরিবর্তন ও অদূরদর্শীতার অভিযোগ

  • আপডেট সময় সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২২, ৮.২৬ এএম
  • ২৭ বার পড়া হয়েছে

ডেস্ক রিপোর্ট॥

ব্যাংকিং লেনদেনের সময় পরিবর্তনের কারনে গত ৮ নভেম্বর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) স্টক এক্সচেঞ্জকে শেয়ারবাজারে লেনদেনের সময়সূচীতে পরিবর্তন আনার নির্দেশ দেয়। ওই সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি যেভাবে লেনদেনের সময় বেধেঁ নির্দেশ দিয়েছিল, তা কার্যকরের আগেই আজ (১৪ নভেম্বর) পরিবর্তন এনেছে। এমন একটি সাদামাটা বিষয়েও বিএসইসি একবারে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি মাঝেমধ্যেই এমন সব আইন-কানুন প্রণয়ন ও নির্দেশনা জারি করে, যা কিছুদিনের মধ্যেই আবার পরিবর্তন করে। এমনকি কার্যকরের আগেও পরিবর্তন আনে। এভাবেই চলছে দেশের শেয়ারবাজারের হালচাল। অনেকটা শেয়ারবাজারে সিকিউরিটিজের উত্থান-পতনে বিনিয়োগকারীরা যেমন অস্থির হয়ে পড়েন, ঠিক একইরকম আচরন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিও। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে শেয়ারবাজারে স্বাভাবিকতা ফিরবে কিভাবে।

বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) প্রধান কাজ অনিয়ম রোধ করা হলেও মূল্যসূচকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যা শেয়ারবাজারের পরিপন্থী। দীর্ঘদিনের এই অভিযোগ থেকে কোনভাবেই বেরিয়ে আসতে পারছে না বিএসইসি। যে কারনে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোন আইন-কানুন বা নির্দেশনা জারির দু-একদিনের মধ্যে পরিবর্তনের সিদ্ধান্তও নেয়। এমনকি লেনদেনের সময় নির্ধারনের মতো সাদামাটা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও বিএসইসিকে দোদুল্যমান অবস্থায় পড়ে যেতে হয়। এতে করে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দূরদর্শীতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।

শেয়ারবাজারে সূচকের উঠানামা বিনিয়োগকারীদের চাহিদার উপরে নির্ভর করবে-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাজারে পতন হলে মাঝেমধ্যেই চাহিদা বাড়ানোর চেষ্টা করে বিএসইসি। সেটা সূচকের সঙ্গে মার্জিন ঋণের অনুপাত বেধেঁ দিয়ে কিংবা বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজে ফোন দিয়ে বিক্রির চাঁপ তৈরী না করা ও কেনার জন্য আহ্বানের মাধ্যমে। এভাবে কৃত্রিম উত্থান বা পতনরোধ করা সাময়িকভাবে গেলেও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

এই কারনেই বাজারকে বাজারের মতো চলতে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন স্বাভাবিক। পতনের মাধ্যমে যদি কোন শেয়ার অবমূল্যায়িত হয়ে যায়, তাহলে তার ক্রেতা অবশ্যই ফিরে আসবে। এতে করে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরাই লাভবান হবেন। কিন্তু কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টির মাধ্যমে উত্থানে স্বার্থনেস্বী মহলের মুনাফা করার সম্ভবনা বেশি হয়ে যায়।

তাই শেয়ারবাজারের উন্নয়নে কোন আইন-কানুন প্রণয়নের আগে, তা নিয়ে গবেষণা করা দরকার। এজন্য ডাটাবেজ জরুরী হলেও বিএসইসি আজ পর্যন্ত তা করতে পারেনি। এছাড়া বাহিরের দেশের আইন-কানুন প্রণয়ন কপি করলেও, কৃত্রিমভাবে পতনরোধ করতে গিয়ে তা দফায় দফায় পরিবর্তন করে বিএসইসি।

এই করতে গিয়ে কমিশন পাবলিক ইস্যু রুলস, মার্জিন ঋণ, চেক নগদায়ন ইত্যাদি ইস্যুতে দফায় দফায় পরিবর্তন এনেছে। তাহলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি কিসের ভিত্তিতে ওই সব আইন-কানুন প্রণয়ন বা নির্দেশনা জারি করেছিল, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এছাড়া কৃত্রিমভাবে পতনরোধে ফ্লোর প্রাইস বেধেঁ দেওয়ার সিদ্ধান্ত, যেটি শেয়ারবাজারের মূল স্পিডের সঙ্গে যায় না-সেটা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে রয়েছে আলোচনা-সমালোচনা।

সম্প্রতি চেক নগদায়ন না হওয়া পর্যন্ত লেনদেন করা, না করার সুযোগ নিয়ে এমনই এক সিদ্ধান্তে কয়েকদিনের ব্যবধানে পরিবর্তন এনেছে বিএসইসি। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি গত ১১ অক্টোবর গ্রাহকের চেক ব্রোকারেজ হাউজের হিসাবে নগদায়ন বা জমা না হওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগকারী লেনদেন করতে পারবে না বলে নির্দেশনা জারি করে। কিন্তু এরপরে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তেই ২ নভেম্বর সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে।

এছাড়া মূল্যসূচকের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সূচকের সঙ্গে মার্জিন ঋণের অনুপাত নির্ধারণ করে দেয়। ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সূচকের সঙ্গে সমন্বয় করে মার্জিন ঋণের নির্দেশনা জারি করে শিবলী কমিশন। যার আগে সবক্ষেত্রেই মার্জিন রেশিও ১ টাকার বিপরীতে সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা বা ১:০.৫০ ছিল। ওই নির্দেশনায় ডিএসইএক্স সূচক ৪ হাজারের নিচে থাকাকালীন ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক গ্রাহকদের সর্বোচ্চ ১:১ হারে মার্জিন ঋণ দিতে পারবে বলে জানানো হয়। এছাড়া ৪০০১-৫০০০ পর্যন্ত সূচকের ক্ষেত্রে ১:০.৭৫ হারে, ৫০০১-৬০০০ পর্যন্ত সূচকের ক্ষেত্রে ১:০.৫০ হারে এবং ৬০০০ এর উপরে সূচকের ক্ষেত্রে ১:০.২৫ হারে মার্জিন ঋণ দিতে পারবে।

যা কার্যকর হওয়ার আগেই সংশোধনী আনে শিবলী কমিশন। ওই সংশোধনীতে ডিএসইএক্স সূচক ৪ হাজারের নিচে থাকাকালীন ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক গ্রাহকদের সর্বোচ্চ ১:০.৭৫ হারে মার্জিন দিতে পারবে বলে জানানো হয়। এছাড়া ৪০০১-৭০০০ পর্যন্ত সূচকের ক্ষেত্রে ১:০.৫০ হারে এবং ৭০০০ এর উপরে সূচকের ক্ষেত্রে ১:০.২৫ হারে মার্জিন ঋণ দিতে পারবে বলে বলা হয়েছিল।

এর পরে গত বছরের ৪ এপ্রিল সূচক ৭ হাজার পর্যন্ত মার্জিন ঋণ প্রদানের রেশিও ১:০.৫০ থেকে বাড়িয়ে ১:০.৮০ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কমিশন। এরপরে ১২ আগস্ট ডিএসইএক্স সূচক ৮০০০ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের তাদের নিজস্ব বিনিয়োগের বিপরীতে মার্জিন ঋণ গ্রহনের রেশিও ১:০.৮০ করা হয়েছিল। আর ডিএসইএক্স ৮ হাজার এর উপরের ক্ষেত্রে বা বেশি সূচকের ক্ষেত্রে মার্জিন ঋণ রেশিও ১:০.৫০ নির্ধারন করা হয়েছিল।

এরপরে গত ১৫ নভেম্বর বিএসইসি এক নির্দেশনায় জানায়, মূল্যসূচক যতই হক না কেনো, সবক্ষেত্রেই বিনিয়োগকারীদেরকে নিজস্ব ১ টাকার বিপরীতে ৮০ পয়সা বা ৮০% মার্জিন সুবিধা নিতে পারবে। এটাও পরিবর্তন করে গত ২২ মে মার্জিন ঋণ সুবিধা ১:১ বা নিজস্ব ১ টাকার বিপরীতে ১ টাকা পর্যন্ত মার্জিন ঋণ নেওয়ার বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ফ্লোর প্রাইস নিয়ে এক প্রকার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তিনি গত ৩১ জুলাই এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমরাও দর কমার ক্ষেত্রে ২% সার্কিট ব্রেকার এবং ফ্লোর প্রাইস দিতে চাই না। কিন্তু সাধারন বিনিয়োগকারীদেরকে রক্ষা করার জন্য দিতে বাধ্য হই। কারন আমাদের দেশে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশি। উন্নত দেশে শিক্ষিত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এমনটি করা লাগে না।

এভাবে কৃত্রিমভাবে বাজারকে ঠেক দিয়ে রেখে বিনিয়োগকারীদেরকে কতটা শিক্ষিত করা যাবে, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এছাড়া এই কৃত্রিমভাবে বাজারকে ঠেক দিতে গিয়ে অসংখ্য কোম্পানির হাজার হাজার বিনিয়োগকারীকে লেনদেন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে অনেকে প্রয়োজন সত্ত্বেও টাকা তুলতে পারছেন না।

এদিকে লেনদেনের সময়সূচী নিয়ে গত ০৮ নভেম্বর বিএসইসি জানিয়েছিল, ১৫ নভেম্বর থেকে শেয়ারবাজারের লেনদেন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ২টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত হবে। আর প্রি-ওপেনিং সময় ১০টা ২৫ মিনিট থেকে ১০টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত নির্ধারণ করেছিল। আর পোস্ট-ক্লোজিং সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২টা ৫০ মিনিট থেকে ৩টা পর্যন্ত।

তবে ওই সময়সূচী কার্যকরের আগেই বিএসইসির আরেক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ১৫ নভেম্বর থেকে সকাল ১০টায় শেয়ারবাজারের লেনদেন শুরু হবে। যা বিরতিহীনভাবে চলবে ২টা ২০ মিনিট পর্যন্ত। এতে প্রি-ওপেনিং সময় সকাল ৯টা ৫৫ মিনিট থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত। আর পোস্ট-ক্লোজিং সময় দুপুর ২টা ২০ মিনিট থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com