স্বর্ণময়ী মোস্তফা ঐশী॥
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বে ১.২৮ বিলিয়ন মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে, যার দুই—তৃতীয়াংশ বাস করে বাংলাদেশসহ নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশে। বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজনের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, যাদের অধিকাংশ, অর্ধেক নারী (৫১%) এবং দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষ (৬৭%), জানেই না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে তরুণদের মধ্যেও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপজনিত অসুস্থতা এবং অকালমৃত্যুর বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগজনিত অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (লক্ষ্য ৩.৪) অর্জন কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।
উচ্চ রক্তচাপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশব্যাপী এ বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরি এবং সকল কমিউনিটি ক্লিনিকে রক্তচাপ পরীক্ষা ও উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রয়োজন এ খাতে সরকারের বাজেট বাড়ানো।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা রিজলভ টু সেইভ লাইভস (আরটিএসএল) এর সহায়তায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনসিডিসি) ২০১৮ সাল থেকে যৌথভাবে উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয়, চিকিৎসা ও ফলো-আপ সেবা শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে সিলেট, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের ৫৪টি উপজেলায় কাজ করছে।
বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের এই কর্মসূচিটি বিশ্বে প্রচলিত সর্বোত্তম পদক্ষেপসমূহ অনুসরণ করে সাজানো হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, সেবা প্রদান এবং সেবা গ্রহণের ধারবাহিকতা ঠিক রাখতে উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসায় সহজ ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল এর সাথে সুনির্দিষ্ট ওষুধ, প্রয়োগ মাত্রা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা; টিম ভিত্তিক সেবা প্রদান এবং টাস্ক শেয়ারিং; সাশ্রয়ী মূল্যের এবং ভাল মানের ওষুধ সরবরাহ চালু রাখা; রোগী-কেন্দ্রিক সেবা প্রদান যেমন, সহজে গ্রহণ করা যায় এমন ওষুধের ব্যবস্থা, বিনামূল্যে ওষুধ প্রদান ও নিয়মিত ফলো-আপ করা; এবং কার্যকরী স্বাস্থ্য তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের খোঁজ রাখা এবং সেবার মানের দ্রুত উন্নতি সাধন করা।
বর্তমানে, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধগুলি কমিউনিটি ক্লিনিকের বিদ্যমান ওষুধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নয়। এই কর্মসূচির আওতায় সিলেট জেলায় প্রাথমিকভাবে চারটি উপজেলার আটটি কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চ রক্তচাপ এর ওষুধ দেওয়া শুরু হয়েছে।
এই কর্মসূচির দেশব্যাপী সম্প্রসারণের মাধ্যমে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং হার্টঅ্যাটাক ঝুঁকির প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের এই কর্মসূচিটি বিশ্বে প্রচলিত সর্বোত্তম পদক্ষেপসমূহ অনুসরণ করে সাজানো হয়েছে।
বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভে, ২০১৮ অনুযায়ী, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের মধ্যে ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে প্রতি ৭ জনে একজনেরও কম। গ্লোবাল বারডেন অফ ডিজিজ স্টাডি, ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চ রক্তচাপ। দেশে উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে প্রশিক্ষিত কর্মী রয়েছে মাত্র ২৯ শতাংশ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) এর লাইন ডিরেক্টর ডা. মাসুদ রেজা কবির বলেন ইতোমধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসাসেবা শুরু হয়েছে এবং অল্প সময়ের মধ্যে দেশের সব কমিউনিটি ক্লিনিকে এই কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাইমারী হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ইন্টেগ্রেটেড থানা হেলথ কমপ্লেক্স এর পরিচালক ডা. তাহমিনা সুলতানা জানান, “সীমিত পর্যায়ে কিছু কিছু কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে যা পর্যায়ক্রমে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে”।
বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ন, শারীরিক পরিশ্রম অত্যন্ত কম এমন জীবনাচরণ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য গ্রহণ, এবং অন্যান্য আর্থ-সামাজিক ও জীবনযাত্রা সম্পর্কিত বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের বোঝা আগামী বছরগুলোতে বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পটি সম্প্রসারণ করা হলে অল্প ব্যয়ে অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।