এফবিডি ডেস্ক॥
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” মানবসভ্যতার অগ্রগতির মূলে রয়েছে নারী-পুরুষের সমান অবদান। কবির সেই কথামালার যেনো বাস্তব প্রতিফলন মেলে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার নলসন্ধ্যা চরে।
বিস্ময়কর হলেও সত্য বাড়ির ছোট্ট উঠোন থেকে শুরু করে বিঘার পর বিঘা জমিতে একাই কাজ করছেন নারীরা। পরিসংখ্যান বলছে, সেখানে প্রত্যক্ষভাবে কৃষিকাজের সাথে জড়িত প্রায় ৫৩ শতাংশ নারী। আর পরোক্ষভাবে ৮০ শতাংশের বেশি।
তেমনই একজন লাভলী। ৩০ বছর বয়সী এ নারী দুই সন্তানের জননী। স্বামী রাজমিস্ত্রী। কাজ করেন বিভিন্ন জেলায়। নবম ও ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া ২ সন্তানকে নিয়ে লাভলী থাকেন নলসন্ধ্যা চরে। কৃষিকাজ করে দুর করেছেন সংসারের অভাব। নিজের ১ বিঘা জমিতে উৎপাদন করছেন গাজর, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বাদাম, শাক, ভুট্টা,পাট, মরিচ, ধানসহ নানা সবজি।
বীজ লাগানো, সার ,পানি ও কীটনাশক দেয়া, ফসল কাটা পর্যন্ত প্রতিটি কাজ নিজ হাতে করেন তিনি। পাশাপাশি করেন দেশি মুরগি ও গরু-ছাগল পালন।
কষ্টে দিন কাটানো লাভলীর জীবনে পরিবর্তন আসতে শুরু করে ২০২০ সাল থেকে। অভাব অনটনের পরিবারে মেলে স্বচ্ছলতার দেখা।
সঠিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ ও হাঁস-মুরগি পালনের পদ্ধতি জানা ছিলো না লাভলীর। এখন লাভলীর গোয়ালের গরু থেকেই মিটছে পরিবারের পুষ্টির চাহিদা। খামারের মুরগির ডিম-মাংস খেয়ে খুশি তার সন্তানেরা ।
নিজেদের পুষ্টির চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা বিক্রি করে বাড়তি আয় করছেন লাভলী।
শুধু তা-ই নয় তার খামারে বর্তমানে দেশি মুরগি আছে ৫০টি। এখন পর্যন্ত বিক্রি করেছেন প্রায় ৩০০ মুরগি। প্রতিটি মুরগি ৫০ টাকা করে কিনে মাস দু’য়েক লালন-পালনের পর ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি করেন। এতে তার মুরগি প্রতি লাভ থাকে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। দিন দিন বাড়ছে লাভলীর সঞ্চয়ের খাতা।
এমনই আরেকজন সকিনা বেগম। স্বামী মুদি দোকানী। কৃষিকাজ করেন সকিনা। পাশাপাশি লাভলীর মত করেন গবাদি পশু পালন।
এখন আর অভাব নেই সকিনার সংসারে। তিন বেলা পেটপুরে খান পরিবারের সবাই।
লাভলী ও সকিনার এ গল্প চরের অসংখ্য নারীর। ২ বছর আগেও এমন ছিলো না প্রেক্ষাপট।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ নারীরা জানান, আগে তারা কিছু করতেন না। এখন নিজেদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও খাবার বিক্রি করে স্বাবলম্বী তারা। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন বাড়িয়েছে প্রান্তিক নারীর আত্মবিশ্বাস।
আগে কেমন ছিলো লাভলীদের জীবন
জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের আওতাধীন নলসন্ধ্যা চর। সেখানে জনসংখ্যা প্রায় ৭ হাজার।
স্থানীয়রা জানান, ৪০ বছর আগে গোড়াপত্তন হয় এ চরের। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছিলো সেখানের বাসিন্দাদের জীবন। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, উচ্চ পরিবহণ খরচ ও সঠিক উপায়ে চাষাবাদের পদ্ধতি না জানায় অধিক শ্রমেও পেতেন না কাঙ্খিত ফলন। অভাব ছিলো নিত্যসঙ্গী।
গত ২ বছর থেকে বদলে যেতে শুরু করে চিত্র। চরের বাসিন্দারা এখন শিখেছেন আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি। সেই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ঘরে তুলছেন সোনার ফসল।
এ মানুষগুলোর ভাগ্যবদলে সহায়তা করেছে এমফোরসি প্রজেক্ট (মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর চর)। অর্থায়নে রয়েছে সুইজারল্যান্ড।
উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ
চরের বাসিন্দা মোঃ আসাদ সরকার বলেন এখন আমরা সবাই সচেতন। কোন বীজ লাগাতে হবে, কখন কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে, কখন ফসল কাটার উপযুক্ত সময় এ সবকিছু জানি আমরা। আগে ভুট্টা মণ বিক্রি করতাম ৪০০ টাকা করে। সেখানে এখন বিক্রি করি ১২০০ থেকে ১৩০০ করে। প্রতি মণ মরিচে আগে যেখানে পেতাম ২ হাজার টাকা। এখন পাই ৬ হাজার।
স্থানীয়রা জানান; আগে প্রতি বিঘা জমিতে ২৫ মণ ভুট্টা উৎপাদিত হতো বর্তমানে সেটি বেড়ে হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ মণ। সরিষা হতো ২৫ মণ বর্তমানে হয় ৪০-৪৫ মণ।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য শাহনাজ পারভীন বলেন; “অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা বদলে দিয়েছে চরের সামগ্রিক জীবন। নারীদের করেছে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। এর ফলে তাদের জীবনে যে পরিবর্তন এসেছে যা আগে তারা চিন্তাও করতে পারতেন না।”
কী করছে এমফোরসি
এমফোরসি প্রজেক্টের ইন্টারভেশন স্পেশালিস্ট মোঃ শামসুল আলম বলেন; “চর এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আয় বাড়ানো ও বিপদাপন্নতা কমিয়ে আনতে কাজ করছে এমফোরসি প্রজেক্ট। এজন্য আমরা মাঠ পর্যায় থেকে পদ্ধতি উন্নয়ন করছি।”
প্রজেক্টের ফিল্ড অফিসার মোঃ মেহেদি হাসান বলেন; “আমরা সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করি। কাজ করি বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে। আমরা তাদেরকে বিভিন্ন কোম্পানির সাথে সংযুক্ত করিয়ে দেই। এভাবে গড়ে তুলি ডিস্ট্রিবিউশন মার্কেট।”
প্রজেক্টের সিনিয়র ম্যানেজার মোঃ তৌহিদুল ইসলাম বলেন; “চরাঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি ও তাদের জীবনমান উন্নত করা; এবং প্রতিনিয়ত যে প্রাকৃতিক দুর্যাগগুলোর মধ্যে দিয়ে তারা যায় সেই দুর্যাগ ঝুঁকি হ্রাস করতে কাজ করছে এ প্রজেক্ট। নারীদের জীবনমান উন্নত করা এ প্রজেক্টের অন্যতম লক্ষ্য।”
এমফোরসি প্রজেক্ট সারাদেশে ৬ জেলার ৩০টি উপজেলার প্রায় ৮০০ চরে কাজ করছে। এর সেবাভোগী চরের প্রায় ৭৫ হাজার পরিবার।
জামালপুরের নলসন্ধ্যা চরে এ প্রজেক্ট প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে ১৫০ পরিবার নিয়ে। পরোক্ষভাবে এখান থেকে তথ্য সহায়তা পাচ্ছে প্রায় ১ হাজার ২০০ পরিবার।
প্রজেক্টের আওতায় প্রান্তিক নারীরা কৃষিকাজ ও পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করছে। সেই সঙ্গে নারীদের নিজেদের শরীরের যত্ন নেওয়া, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া ইত্যাদি বিষয়েও পরামর্শ দেয় এ প্রজেক্ট।
রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ
প্রতিনিয়ত বিভন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় চরের মানুষের। অনেক সময় ফসল তোলার আগে বন্যায় তলিয়ে যায় সব। পণ্ড হয় সারা বছরের শ্রম।
অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে মাথায় ফসল নিয়ে হাঁটতে হয় মাইলের পর মাইল। পায়ে হেঁটে গ্রীষ্মকালে ধু ধু চর আর বর্ষায় কাদাপানি, নদী পেরিয়ে যেতে হয় বাজারে। গুণতে হয় বাড়তি টাকা।
যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজীকরণের পাশাপাশি সরকারের কাছে সহজ শর্ত ঋণ চান এখানকার নারীরা। তাদের প্রত্যাশা সরকার সহযোগিতা করলে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবেন তারা।