বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৬ পূর্বাহ্ন

জুতায় স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ

  • আপডেট সময় বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২২, ৯.১৬ এএম
  • ২১ বার পড়া হয়েছে

এফবিডি ডেস্ক॥

দেশের একজন জ্যেষ্ঠ নাগরিক মো. ইউনুসূর রহমান। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক সিনিয়র এই সচিব বর্তমানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।  তিনি বলেন, ‘আমি গ্রামে বড় হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। স্বাধীনতার আগের অভিজ্ঞতা যদি বলি, তখন গ্রামে ১০ শতাংশের বেশি মানুষ জুতা বা স্যান্ডেল কিছুই পরতেন না। তারা সন্ধ্যা সময় ঘরে ফিরে পা ধুয়ে খড়ম পরতেন।’

এই পরিস্থিতি কয়েক দশক আগেও ছিল। আশির দশকের শেষ দিকেও গ্রামাঞ্চলে খালি পায়ে স্কুলে যেতে দেখা যেত শিক্ষার্থীদের। শুধু সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোয় বেশির ভাগ নিয়ম মেনে জুতা পরত। অপ্রাপ্তবয়স্কদের অনেকে ওইসব অনুষ্ঠানেও জুতা পরত না। সেই পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে গেছে। এখন শহর কিংবা গ্রাম- সবখানে জুতা না পরাটাই যেন বিরল ঘটনা। এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ, জুতার দাম সাধ্যের মধ্যে চলে আসা। সবাই হয়তো হালফ্যাশনের জুতা পরেন না। সামর্থ্যও নেই সবার। তবে এক জোড়া রাবার বা প্লাস্টিকের স্যান্ডেল কিংবা স্লিপার কেনার সামর্থ্য দেশের সিংহভাগ মানুষেরই রয়েছে।

এটা সম্ভব হয়েছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের কল্যাণে। ব্র্যান্ড এবং নন-ব্র্যান্ডের স্থানীয় জুতা প্রস্তুতকারীরা গত কয়েক দশক ধরে এই বিপ্লব ঘটিয়েছে, যা জুতাকে সবার জন্য সহজলভ্য করেছে।

১৯৬২ সালের আগে বাংলাদেশে জুতার বড় কারখানা ছিল না। তখন জুতার চাহিদা মিটত কলকাতা বা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করে। স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশ ছিল আমদানিনির্ভর। তবে বাংলাদেশের জুতা রপ্তানিকারকদের সংগঠন লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) তথ্য বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে জুতা তৈরি হয়েছে ৪০ কোটি ১০ লাখ জোড়া। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ৮ কোটি ৩০ লাখ জোড়া রপ্তানিও হয়েছে দেশ থেকে। জুতা উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অষ্টম। অবশ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও গ্রাহক চাহিদার কারণে এখনো বাংলাদেশে ১ কোটির বেশি জোড়া জুতা আমদানি হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনমিকসের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণার তথ্য না থাকলেও, প্রায় নিশ্চিতভাবেই বোঝা যায়, বর্তমানে দেশের কর্মজীবী মানুষও অনেক স্বাস্থ্য সচেতন। তারা নিয়মিত জুতা পরেন।’

ক্যাম্পেইন ফর এডুকেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর কে এম এনামুল হক ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে স্কুলগামী শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘২০০৩ সালের পর স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে জুতা ব্যবহারের হার বাড়তে থাকে। বর্তমানে পার্বত্য বা চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও অন্তত স্যান্ডেল কিংবা স্লিপার পরে স্কুলে যায়।’

১৯৬২ সালে বহুজাতিক কোম্পানি বাটা আসে বাংলাদেশে। টঙ্গিতে স্থাপন করে কারখানা। তখন থেকে বাংলাদেশে বড় আকারে জুতা তৈরি শুরু। এরপর ১৯৬৭ সালে ইস্টার্ন প্রগ্রেসিভ শু ইন্ডাস্ট্রি (ইপিএসআই) বাংলাদেশে জুতা তৈরির কারখানা স্থাপন করে। স্বাধীনতাযুদ্ধে জুতা তৈরির কারখানাগুলোর বড় ক্ষতি হয়।

সাবেক সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসূর রহমান বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে ১ থেকে ২ শতাংশ মানুষ বাটার জুতা পরতেন। ৯ শতাংশ মানুষ পরতেন স্পঞ্জের স্যান্ডেল। ৯০ শতাংশ মানুষ কিছুই পরতেন না। সে সময় যদি কোনো বাসায় ৫ থেকে ৬ জন লোক থাকত, তাহলে হয়তো এক জোড়া খড়ম বা এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল থাকত। আমরা যারা দু-চারজন সেই সময় স্যান্ডেল পরতাম, তারা স্কুলে গেলে অন্যরা মনে করত বড়লোক।’

অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ইউনুসূর রহমান আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার পরও স্যান্ডেল পরেছি। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি তখনো স্যান্ডেল পায়ে এসেছি। ফার্স্ট বা সেকেন্ড ইয়ারে উঠে জুতা কিনেছি।’

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটির মতো। এর মধ্যে ৬ কোটির মতো মানুষ গ্রামে থাকতেন। গ্রামে ১০ শতাংশ লোক জুতা পরতেন। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলে জুতার চাহিদা ছিল ৬০ লাখ জোড়া। আর শহরে ৮০ শতাংশ মানুষ জুতা পরতেন ধরলে সে সময় চাহিদা ছিল ৮০ লাখ জোড়া জুতার। সে হিসেবে তখন জুতার সর্বমোট চাহিদা ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ জোড়া। এই চাহিদা মেটানো হতো দেশের হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির উৎপাদন এবং আমদানি করা জুতা দিয়ে। তবে ৫০ বছর পর বাংলাদেশ দেখছে সম্পূর্ণ নতুন চিত্র।

এলএফএমইএবির তথ্য বলছে, ২০২১ সালে ৪০ কোটি ১০ লাখ জোড়া জুতা তৈরি করেছে দেশের কোম্পানিগুলো। ওই বছর বাংলাদেশের মানুষ জুতা ব্যবহার করেছে ৩৩ কোটি ৩০ লাখ জোড়া। আর রপ্তানি হয়েছে ৮ কোটি ৩০ লাখ জোড়া। গ্রাহক চাহিদার কারণে দেড় কোটি জোড়া জুতা আমদানি হয়েছে ওই বছর।

দেশীয় কোম্পানিগুলো এখন জুতার বাজারে বিনিয়োগ করেছে। এতে মোট বাজারে দেশীয় ব্র্যান্ডের হিস্যা বাড়ছে। শুধু দেশের মানুষ নয়, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের মানুষের পায়ে শোভা পাচ্ছে বাংলাদেশে তৈরি জুতা।

ব্র্যান্ডের জুতাগুলো বাজারে আসার আগে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় ছোট উদ্যোক্তারা জুতা তৈরি শুরু করেন। এক সময় ভারতের বিভিন্ন এলাকায় জুতার কারখানায় কাজ করা অনেক বিহারি নিজেদের দক্ষ কারিগর হিসেবে তৈরি করেছিলেন। তারা বাংলাদেশে এসে পুরান ঢাকায় নিজেরাই কারখানা গড়ে তোলেন। স্বাধীনতার পর বাঙালি শ্রমিকরা এসব কারখানা চালু রাখেন এবং নিজেরাই কারখানার মালিক হন।

পরবর্তী সময় পুরান ঢাকার এই নন-ব্র্যান্ড জুতা কারখানাগুলো থেকেই সারা দেশে এ শিল্প ছড়িয়ে পড়ে। তবে জুতাশিল্পের সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি ঘটে আশির দশকে। এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, দেশের আনাচে-কানাচে প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার নন-ব্র্যান্ড জুতার কারখানা আছে। পুরান ঢাকাতেই আছে ৫ থেকে ৬ হাজার কারখানা। রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীতে দুই শতাধিক কারখানা আছে। এ ছাড়া কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ১০ হাজারের বেশি, চট্টগ্রামের মাদারবাড়ীতে ৬০০ থেকে ৭০০, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩০০ এবং রাজশাহীতে শতাধিক কারখানা আছে। এ ছাড়া কুমিল্লা, গাজীপুর, নরসিংদী আর নারায়ণগঞ্জেও অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে।

অন্যদিকে ব্র্যান্ডের জুতার বাজারে শীর্ষে আছে বাটা ও অ্যাপেক্স। এ ছাড়া ওরিয়ন গ্রুপের ওরিয়ন ফুটওয়্যার, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ওয়াকার, ইউএস-বাংলা গ্রুপের ভাইব্র্যান্ট ব্র্যান্ডের জুতা দেশের বাজারে আছে। আছে লেদারেক্স, জেনিস, ফরচুন, জিলস, হামকো, স্টেপসহ আরও বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড। এসব ব্র্যান্ড ভাগ বসিয়েছে এক সময়ের দাপুটে বহুজাতিক ব্র্যান্ড বাটার ব্যবসায়।

অ্যারো ম্যানুফেকচারিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং আর জে এম ফুটওয়্যার লিমিটেডের জসীম আহমেদ বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এ খাতে ফোকাস করেন। চামড়া আমাদের নিজস্ব আছে। কেননা আমরা এটাকে প্রমোট করি। তারপর ’৮০ সালের পর থেকে ট্যানারিশিল্প গ্রো করে। চামড়া রপ্তানিতে ভ্যালু অ্যাড হচ্ছিল না। তাই জুতা রপ্তানি শুরু হয়। তারপর জুতার কারখানাগুলো আসতে শুরু করে।

এরপর কাস্টমার আসে, বিনিয়োগ আসে। চামড়ার জুতা আমরা এখন পুরো ১০০ শতাংশ করছি। যেটা আমদানি হয়ে আসে সেটা খুবই কম। আমাদের স্পোর্টসওয়্যার যেটা আছে সেটা আগে ১০০ ভাগ আমদানি হয়ে আসত। সেটা এখন আমাদের দেশেও গ্রো করছে।’

একসেচুয়ার ফুট প্রোডাক্ট অ্যান্ড লেদার প্রোডাক্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘বাটা বাংলাদেশের জুতার বাজার পরিবর্তন করে দিয়েছে। যারা বাটায় কাজ করেছেন, তারা বের হয়ে নতুন কারখানা শুরু করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে এই খাতে দক্ষ লোক তৈরি হয়। এরপর বড় বড় গ্রুপ এই খাতে বিনিয়োগ করা শুরু করে। ফলে দেশে জুতার বাজার আজকের অবস্থায়। শূন্য থেকে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ।’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com