এফবিডি ডেস্ক॥
বাংলাদেশের মানুষের আরেকটি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। পদ্মা সেতুর পর এবার চালু হলো বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বুধবার বেলা ১১টা ৪ মিনিটে উত্তরায় উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন। এর মধ্য দিয়ে উন্মোচন হলো রাজধানীতে যোগাযোগব্যবস্থার নতুন অধ্যায়।
রাজধানীর উত্তরা (দিয়াবাড়ি) থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে, তবে বুধবার উদ্বোধন হয় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের, যার দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।
উত্তরা-মিরপুর এলাকার সর্পিল রেলপথ, সুদৃশ্য স্টেশন এবং ঝা-ঝকঝকে রাস্তা তাক লাগিয়ে দিচ্ছে চোখে। প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন দুর্বিষহ দিন পেছনে ফেলে উচ্ছ্বসিত মানুষ। ইতিহাসের অংশীদার হতে প্রতীক্ষায় ছিল সবাই। ঢাকার গণপরিবহনে নতুন যুগের সূচনা হলো।
বিজয় সরণি থেকে পল্লবী পর্যন্ত পরিষ্কার-ঝকঝকে রাস্তা। কেউ হঠাৎ করে এই এলাকায় গেলে চিনতেই পারবেন না। রাজধানীর বড় বড় ফার্নিচারের শোরুম তালতলা, শেওড়াপাড়া-কাজিপাড়া-মিরপুর-১০-এ অবস্থিত। হাতিল, আখতার, পারটেক্স, অটোবিসহ নামি ব্যান্ডের একাধিক শোরুম রয়েছে রাস্তার দুই পাশে। এ ছাড়া অন্য কোম্পানির হাজারের বেশি শোরুম আছে এই এলাকায়।
সোমবার দুপুরে শেওড়াপাড়ার নাজমা ফার্নিচারের মালিক আজমল হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সত্যিই চিনতে পারছি না আমার নিজ এলাকাকে। ৫-৬ বছরের কষ্টের অবসান হয়েছে আমাদের। এই কবছর রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থার কারণে ব্যবসা করতে পারিনি। লোকসান দিয়েছি। এখন মনে হয় সুদিন আসছে। মেট্রোরেলে চড়ে লোকজন ফার্নিচার কিনতে আসবেন। আমরা সেই আশায় আছি।’
মিরপুর-১০ নম্বরে তারেক ফার্নিচারের মালিক মোহাম্মদ তারেক বলেন, ‘সত্যিই সুন্দর লাগছে। কোনো দিন ভাবতেও পারিনি, এমন ঝকঝকে-সুন্দর মিরপুর দেখতে পাব। গত কয়েক বছর তেমন ব্যবসা করতে পারিনি। এখন সেটা পুষিয়ে নেয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে।’
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং বহুমুখী। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘নগর পরিস্থিতি-২০১৬: ঢাকা মহানগরে যানজট-শাসন-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা ছিল গড়ে ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার, বর্তমানে তা ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেয়া হয়, তাহলে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে বর্তমানে মোট জিডিপির ৩৭ শতাংশ জোগান দিচ্ছে ঢাকা। যানজট না থাকলে এটা আরও বাড়তে পারত। যানজটের কারণে একদিকে শ্রমঘণ্টা ও উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ঢাকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। যানজটের কারণে দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে নগরায়ণের অনেক অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার পাওয়া যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘দুই-আড়াই কোটি জনসংখ্যার রাজধানীতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বড় বাধা নিকৃষ্ট গণপরিবহন এবং অসহনীয় যানজট। একটি টেকসই মধ্য-আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য পর্যায়ে পরিচিতি পেতেও ঢাকার যানজট বড় বাধা। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিপরীতে যানজট সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনাগুলোর ধীরগতির বাস্তবায়নও সমস্যার তীব্রতা বাড়াচ্ছে।’
মেট্রোরেল ঢাকায় তীব্র যানজট সমস্যার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় মেট্রোরেল চালু করার আত্মতৃপ্তি নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। ঢাকার মতো চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরেও এই সেবা চালু করতে হবে। তাহলেই ঢাকার ওপর মানুষের চাপ কমবে; রাজধানীর বাইরেও ঢাকার মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।’
দেশের অবকাঠামো খাত নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত। তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেল এককভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কতটা অবদান রাখবে, সে বিষয়ে কোনো গবেষণা এখনো কেউ করেনি। অনেকেই বলছেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল দেশের জিডিপিতে ২ শতাংশ যোগ করবে। তবে আমার বিবেচনায় মেট্রোরেলের বিষয়টি পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী টানেলের চেয়ে আলাদা। মেট্রোরেল রাজধানীর দুই-আড়াই কোটি মানুষের সময় সাশ্রয় করবে। মানুষ দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারবে। বেশি বেশি কাজ করতে পারবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বেড়ে যাবে। মোট কথা অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করবে মেট্রোরেল।’
পদ্মা সেতুর মতোই মেট্রোরেল অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে বলে মনে করছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
তিনি বলেন, ‘বিজয়ের মাসে আমরা মেট্রোরেল উদ্বোধন করছি। বাংলাদেশের মানুষের আরেকটি স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। পদ্মা সেতুর পর মেট্রোরেল এক অনন্য পাওয়া। বাধাবিপত্তি পেরিয়ে আমরা এভাবেই এগিয়ে যাব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষায় বলতে চাই- দাবায়ে রাখতে পারবা না।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রাথমিক একটা হিসাবে দেখেছি, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ বাড়বে। শুধু পদ্মা সেতু চালুর কারণেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ দশমিক ২ শতাংশ। মেট্রোরেল এবং কর্ণফুলী টানেল নিয়ে আলাদা কোনো প্রাক্কলন করা না হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিনটি মেগা প্রজেক্ট একসঙ্গে চালু হলে দেশে জিডিপিতে প্রায় ২ শতাংশ বাড়তি প্রবৃদ্ধি যোগ হবে।’
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে যানজটে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে প্রতিদিন যথাক্রমে ৩২ ও ১৭ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। যানজটজনিত এক লাখ শ্রমঘণ্টার জন্য বছরে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মিলিয়ে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক এক হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ঢাকা ও চট্টগ্রামে বছরে অন্তত ৪৯ হাজার কোটি টাকা যানজটে নষ্ট হচ্ছে। দুটি শহরের যানজটেই বছরে নষ্ট হচ্ছে সাড়ে ৫ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার, যা ৭০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক বাজেটের পৌনে ৮ শতাংশ।
‘ঢাকায় মেট্রোরেল চালু করার আত্মতৃপ্তি নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। ঢাকার মতো চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরেও মেট্রোরেল চালু করতে হবে। তাহলেই ঢাকার ওপর মানুষের চাপ কমবে; রাজধানীর বাইরেও ঢাকার মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। দেশ আরও এগিয়ে যাবে’ বলেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।