সিরাজুল ইসলাম শিশির:
ভরা মৌসূমেও মাছের সংকটের কারণে বৃহত্তর চলনবিল এলাকায় এ বছর ব্যহত হচ্ছে শুটকি উৎপাদন। ফলে হতাশায় ভুগছেন এ অঞ্চলের শুটকি উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা।
উত্তরাঞ্চলের সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর এই তিন জেলা নিয়ে বিস্তৃত অঞ্চল মিলে জুড়ে আছে বৃহৎ চলনবিল। মৎস্য ভাণ্ডার খ্যাত এই চলনবিলের বিশাল জলাভূমি একদিকে যেমন অন্যতম বড় শস্য ভাণ্ডার, তেমনই মাছেরও বড় জোগান আসে এখান থেকেই। বৃহত্তর চলনবিলের উৎপাদিত দেশীয় মাছের শুঁটকি গত কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ও বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। এতে স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতেও অবদান রেখে চলেছে এ শুঁটকি মাছ।
কিন্তু এ বছর বিলম্বিত বর্ষা ও চলনবিলে দীঘ সময় ধরে পানি না থাকায় এবং বাদাই জাল দিয়ে ক্রমাগত মা মাছ নিধনের ফলে নদ-নদী ও বিলের মাছের বংশ বিস্তার ব্যাহত হয়েছে। এতে করে প্লাবন ভূমিতে মাছের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় শুঁটকি মৌসুমে মাছের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ বছর চলনবিল অঞ্চলে শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ঠরা। যদিও মৎস্য অধিদপ্তর এখনো আশা বাদী এ ব্যাপারে।
জানা যায়, চলনবিল অঞ্চলে প্রায় ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি জলাশয় ও ১৬টি নদীর সমন্বয়ে এ বিলের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে মাছ আহরণ করা হয়। এটি দেশের মিঠাপানির মাছের বড় উৎস। আর এখানকার হরেক প্রজাতির মাছ ঘিরে চলে এলাকার ভিন্ন এক কর্মব্যস্ততা। প্রতি বছরের আগস্ট থেকে ফেব্রয়ারী মাস পর্যন্ত কর্মতৎপর হয়ে ওঠে এখানকার শুঁটকি পল্লীর চাতালগুলো।
এই জনপদের নারী-পুরুষেরা ভোরের আলো ফোটায় সঙ্গে সঙ্গে চলনবিলের শুঁটকি তৈরিতে নেমে পড়ে। এখানে দেশীয় পদ্ধতিতে শুঁটকি তৈরি করা হয়। তাড়াশের মহিষলুটি মাছের আড়ৎ, চাটমোহর উপজেলার বোয়ালমারি, সিংড়া বাজারসহ বিভিন্ন আড়ত থেকে মাছ ক্রয় করা হয়। এরপর তা পৌঁছে যায় শুঁটকির চাতালে। এ সব চাতালে শোল, বোয়াল, খলসা, টাকি, টেংরা, পুটি, কৈ, শিং, মাগুর, রূপচাঁদা, ডানকোনা, রয়না, বেলে, সরপুটি, ছোট চিংড়ি, বাইম, চাপিলা, চেলাপুটি ও চাঁদা মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়। আর এই তৈরিকৃত শুটকি সৈয়দপুর, নীলফামারী, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায় এ সব শুঁটকি মাছ। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ২৫টি দেশে শুঁটকি রপ্তানি হয়।
সম্প্রতি সরেজমিন উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের মহিষলুটি শুটকির চাতালে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে বিভিন্ন স্থানে শুঁটকি তৈরির চাতাল রয়েছে। কিন্তু, শুটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হচ্ছে মাত্র কয়েকটি চাতালে। সামান্য পুঁটি মাছ রোদে শুকানো হচ্ছে। অন্যগুলোতে সব চাটাই গোছানো।
উল্লাপাড়া উপজেলা থেকে আসা শুঁটকি চাতাল মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এ বছর আশঙ্কাজনকহারে বিলের মাছ কমেছে। আড়তে মাছ পাওয়া গেলেও মাছের দাম অনেক বেশি।
শুটকির পুরাতন ব্যবসায়ী ও চাতাল মালিক আলম আলী বলেন, চলনবিলে এ বছর তেমন বর্ষা হয়নি, ফলে চলনবিলে তেমন কোন মাছ ধরা পড়ছে না। এছাড়া মহিষলুটি আড়তেও তেমন মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন ১০০ মণ কাঁচা মাছের প্রয়োজন শুটকির চাতালে। অথচ সর্বোচ্চ তিন থেকে চার মণ মাছ সংগ্রহ করতে পারছি। তাও আবার বেশি দামে মাছ কিনতে হচ্ছে। এ বছর ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ।
আলমাছ,গফুুর ও নান্নু মিয়া নামে আরও কয়েকজন শুটকি ব্যবসায়ী দাবি করেন, আমরা সাধারনত আড়তের অবিক্রিত মাছ কম দামে কিনে শুটকি করে থাকি কিন্তু এ বছর মহিষলুটি আড়তে তেমন মাছ আসছে না।
মহিষলুটি মৎস্য আড়ৎদার রাসেল হোসেন ‘দ্য ডেইলী স্কাই’ কে জানান, মাছ সংকটের কারণে এখানকার অনেক চাতালের কার্যক্রম পুরাপুরি শুরু হয়নি। শুঁটকির চাতালে কাজ করা কয়েক শতাধিক নারী-পুরুষ শ্রমিক বেকার অবস্থায় বসে আছে ।
চাতাল শ্রমিক তারা খাতুন,মাফিয়া খাতুন,রেহানা বেগম ও মরিয়ম খাতুনসহ কয়েকজন বলেন,‘ প্রতিবছরই আমরা শুটকি পল্লীতে ৪ থেকে ৫ মাস কাজ করে থাকি। প্রতিদিন একজন নারী শ্রমিকের মজুরি ২০০ টাকা আর পুরুষের ৪০০ টাকা। এ বছর অবস্থা ভালো না।
সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য শাহিনূর রহমান ‘দ্য ডেইলী স্কাই’ কে বলেন, গত বছর এ জেলায় ৩০২ মিট্রিকটন শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে। এ বছর তেমনই লক্ষ্যেমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও এ বছর চলনবিলে কয়েক দফায় পানি আসা ও দ্রুত শুকিয়ে যাওয়ার কারণে মাছের সংকট দেখা দিয়েছে, তবে ভয়ের কোন কারণ নেই, চাতল মালিকরা বিভিন্ন জেলা থেকে মাছ সংগ্রহ করে শুটকি উৎপাদন করবে। সম্পূর্ন নিরাপদ উপায়ে যাতে শুঁটকি উৎপাদন করতে পারে, এ জন্য স্থানীয় মৎস্য অফিস থেকে তাদেরকে নিয়মিত তদারকি ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।