ডেস্ক রিপোর্ট॥
বাংলাদেশের সক্ষমতার নতুন স্মারক হয়ে দাঁড়িয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে মেগাস্ট্রাকচারটি। চলতি বছরের শেষ নাগাদ চালু হতে যাচ্ছে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার প্রথম ইউনিট। ২০২৫ সালের মধ্যেই চালু হবে দ্বিতীয় ইউনিট। অর্থাৎ, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে পুরোপুরি চালু হতে যাচ্ছে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্প সময়ে জটিল এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নতুন মাইলফলক অর্জন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
চলছে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও জ্বালানি লোডিংয়ের প্রস্তুতি
নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশকে প্রকল্পটি বুঝিয়ে দিতে পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়েছে রাশিয়াও। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয় পারমাণবিক জ্বালানি ইউরেনিয়াম নিয়ে আসার প্রক্রিয়া। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পরমাণু সংস্থা রোসাটমের তত্ত্বাবধানে ৭টি ধাপে ১৬৮টি ইউরেনিয়ামের অ্যাসেম্বলি পৌঁছেছে রূপপুরের প্রকল্প এলাকায়। এখন চলছে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও জ্বালানি লোডিংয়ের প্রস্তুতি।
রোসাটমের ডিজি অ্যালেক্সি লিখাচেভ বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মেগাপ্রকল্পটি এখন সফলতার দ্বারপ্রান্তে। প্রকল্প এলাকায় পারমাণবিক জ্বালানি পৌঁছানোর অর্থই হলো বড় আকারে স্টার্ট-আপ কর্মসূচির জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতির সময় হয়ে গেছে। কমিশনিংয়ের আগে সুক্ষ্ম যন্ত্রপাতিগুলোর ওপর অন্তত দেড় হাজার পরীক্ষা চালানো হবে। এখন পর্যন্ত সব চ্যালেঞ্জ সফলভাবে উতরানো গেছে।
বাংলাদেশ হবে অনেক দেশের জন্য অনুসরণীয়
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, এ ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা বেশ কঠিন কাজ। আমরা পরমাণু বিদ্যুতের যুগে প্রবেশ করেছি। ফুয়েল চলে আসা মানে এটা আমরা অর্জন করেছি। ২০২৪ সালেই প্রথম ইউনিট চালু হবে। আর ২০২৫ সালের মধ্যেই চালু হবে পুরো কেন্দ্র।
পরমাণু বিশেষজ্ঞদের মতে, এত অল্প সময়ের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে নতুন রেকর্ড করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে সক্ষমতার নতুন ধাপে পা রাখছে দেশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগর শিক্ষক অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলামের মতে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ এত হাইটেক প্রযুক্তি চালানোর সক্ষমতা অর্জন করছে। এটা বিশ্বমণ্ডলে আলোচনা হবে। অনেক দেশ আমাদের অনুসরণ করবে। এটা হবে আমাদের মতো দেশের জন্য নতুন মাইলফলক।
উদ্যোগ নেয়া হয় স্বাধীনতার পরই
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ১৯৭৭-১৯৮৬ সালে মেসার্স সোফরাটম কর্তৃক একটি সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন চালানো হয় ও এর মাধ্যমে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন যৌক্তিক বলে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। পরে একনেক কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১২৫ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। ১৯৮৭ সালে জার্মানী ও সুইজারল্যান্ডের দুইটি কোম্পানি কর্তৃক দ্বিতীয়বার সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন করা হয়। এ অধ্যয়নে ৩০০-৫০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।
২০০৯ সালে ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অপরিহার্য কার্যাবলী সম্পাদন’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রাথমিক কার্যাবলী ও পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়। ঐ বছরের ১৩ মে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট অ্যাটমিক অ্যানার্জি কর্পোরেশনের (রোসাটোম) মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
২০১০ সালের ২১ মে এ বিষয়ে ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১১ সালের ৯-১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের পারমাণবিক অবকাঠামোর সার্বিক অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়। ২০১২ সালের ১৯ জুন ‘বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২’ পাশ হয়। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া ফেডারেশন সফরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রাক-প্রারম্ভিক পর্যায়ের কার্যাদি সম্পাদনের জন্য রাষ্ট্রীয় রফতানি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৫ সালে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আইন জারি ও নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড গঠন করা হয়।
লাইসেন্স প্রাপ্তি ও রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপন
২০১৬ সালের ২১ জুন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থান লাইসেন্স দেয় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। ২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নকশা ও নির্মাণ লাইসেন্স দেয়। ঐ বছরের ৩০ নভেম্বর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাই কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর এবং ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লিপাত্র বা রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রথম পরমাণু জ্বালানি (ইউরেনিয়াম) গ্রহণ করে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ইউরেনিয়ামের চালান রূপপুর প্রকল্প এলাকায় পৌঁছেছে।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ
পরমাণু শক্তি দূষণমুক্ত, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উৎস। বিশ্বের অল্পসংখ্যক দেশ উচ্চ প্রযুক্তির পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনায় সক্ষমতা অর্জন করেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট গ্রাজুয়েশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ এরই মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুতের যুগে প্রবেশ করেছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। জ্বালানি নিরাপত্তা, স্থায়িত্ব ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বাংলাদেশকে একটি অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বর্তমান সরকারের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। অচিরেই বাংলাদেশের জনগণ এ প্রকল্পের সুফল ভোগ করবে।