রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৩ অপরাহ্ন

সিরাজগঞ্জসহ আট জেলায় নেই জেলা প্রশাসক

  • আপডেট সময় বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৪, ১০.৫৮ পিএম
  • ১৮ বার পড়া হয়েছে

আটকে যাচ্ছে ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের পদায়নের ফাইল


টিডিএস ডেস্ক


অমলাতান্ত্রিক জটিলতায় গোলমেলে অবস্থায় রয়েছে সরকারের প্রশাসন যন্ত্র। সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা নেই কমপক্ষে ৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে। মাঠপর্যায়ে এক মাস ধরে দুই বিভাগে বিভাগীয় কমিশনার শূন্য। জেলা প্রশাসক (ডিসি) নেই ৮ জেলায়। যুগ্মসচিব ও উপসচিব পদে পদোন্নতির জন্য নোটিশ করা হলেও এসএসবির সভা গত ৪ মাস ধরে স্থগিত। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ প্রায় বন্ধ।

বিগত সরকারের সময় ‘অকারণে বঞ্চিত’দের পদোন্নতি দেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে তাদের পদায়ন হচ্ছে না। পক্ষান্তরে বিগত সরকারের সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়িত অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব এবং উপ-সচিবরা আছেন বহাল তবিয়তে। এই শূন্যতা ও ব্যত্যয় নিয়ে কীভাবে প্রশাসন এগিয়ে যাবে-এমন প্রশ্নে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে জনবল নিয়োগের কাজ চলমান। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের সৃষ্ট জঞ্জাল রাতারাতি শেষ হবে না। বঞ্চিতদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং পদায়ন নিয়ে কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।

প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে শূন্যতা ও বিরাজমান অস্থিরতার বিষয়ে সরকারি চাকরির বিধিবিধান বইয়ের লেখক ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, সচিব, বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ। এসব পদ শূন্য বা ফাঁকা রাখা কোনোক্রমেই ঠিক হচ্ছে না। এতে জনসেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। যোগ্য কর্মকর্তার অভাব বোধ করলে সরকার ৬ মাস থেকে ১ বছরের জন্য সাবেক যোগ্য কর্মকর্তাদের উচ্চ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারে। বিরাজমান পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সাময়িক ব্যবস্থা হিসাবে এ পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এছাড়া পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক যোগ্য লোক আছেন, তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। তবে পদায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই সততা এবং যোগ্যতা প্রাধান্য দিতে হবে।

বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের আহ্বায়ক এবিএম আব্দুস সাত্তার বলেন, আমরা এ অচলাবস্থার দ্রুত নিরসন দাবি করছি। তিনি বলেন, কিছু কর্মকর্তা এবং একজন উপদেষ্টার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জনপ্রশাসনজুড়ে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। তারা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বর্তমান বিপ্লবী সরকার তথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিষয়গুলো আমরা সরকারের গোচরে এনেছি।

এবিএম আব্দুস সাত্তার আরও বলেন, আমরা সরকারকে বলেছি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব আকমল হোসেন আজাদ ও একজন উপদেষ্টাকে অপসারণ করতে হবে। তারা নানা ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইতোমধ্যে তাদের দুর্নীতি তদন্তে উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম কমিটির প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন ব্যক্ত করছে। আশা করি, ন্যায় বিচার পাব এবং তদন্তে দোষী হলে তাদের জনপ্রশাসন থেকে অপসারণ করতে হবে।

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) সভাপতি ড. আনোয়ার উল্লাহ বলেন, প্রশাসনে বিরাজমান স্থবিরতার অবসান চাই। পদোন্নতিপ্রাপ্ত বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদায়নের বিষয়ে আমরা বারবার বর্তমান প্রশাসনকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু অজানা কারণে তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। যাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে তাদের পদায়ন বিলম্বে হলে তারা আবারও বৈষম্যের শিকার হবে। তাদের পদোন্নতি দিয়ে পদায়ন করা না হলে তারা আবার বঞ্চনায় শিকার হবে। পদায়ন তাদের পাওনা, তাদের অধিকার।

প্রশাসনসংশ্লিষ্টরা জানান, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা। সচিব মন্ত্রণালয়ের প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্টিং অফিসার। মন্ত্রণালয় ও বিভাগে যখন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কিংবা উপমন্ত্রী অনুপস্থিতি থাকেন তখন সিনিয়র সচিব, সচিব মন্ত্রণালয়ের কাজ এগিয়ে নেন। বিগত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিদেশ সফরসংক্রান্ত পরিপত্রে বলা হয়েছে, একান্ত জরুরি না হলে মন্ত্রী ও সচিব একসঙ্গে বিদেশ সফর করবেন না। একজন মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত থাকা নিশ্চিতের বিষয়ে পরিপত্রও রয়েছে। কারণ তারা মন্ত্রণালয়ের অভিভাবক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিগত আমলে পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবরা ভয়ে কাতর। কারণ বিগত সরকারের সময়ে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের ওই সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাদের কাছ থেকে দায়িত্বশীল ও দক্ষতার সঙ্গে কর্ম সম্পাদনের আশা অবান্তর। তারা ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করে দিন কাটাচ্ছেন। অথচ তাদের সচিবের রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এমন বাস্তবতায় ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সিনিয়র সচিব কিংবা সচিব না থাকা সরকারের জন্যও সুখকর নয়।

জানা গেছে, বর্তমানে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কোনো সচিব নেই। এছাড়া পরিকল্পনা বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, সুরক্ষা সেবা বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার বিভাগে কোনো সচিব নেই। পরিকল্পনা কমিশনের বিভাগে সচিব পদমর্যাদায় একজন সদস্যের পদ ফাঁকা রয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদকে ৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব হিসাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। তথ্য ও সম্প্রচার সচিব, নৌপরিবহণ সচিবকে ওএসডি করা হয়েছে। পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, সুরক্ষা সেবা বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং পরিকল্পনা বিভাগের সচিব পদমর্যাদায় একজন সদস্যকে ওএসডি করা হয়েছে।

বিগত সরকারের সময় বিভিন্নভাবে বঞ্চিত ২০৬ জন কর্মকর্তাতে আগস্টে অতিরিক্ত সচিব হিসাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরে তাদের আগের মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তি দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে থেকে ইতোমধ্যে মাত্র কয়েকজনকে সচিব হিসাবে পদায়ন করা হলেও বিগত সময়ে পদোন্নতি বঞ্চিত অধিকাংশ কর্মকর্তাকে কাঙ্ক্ষিত স্থানে পদায়ন করা হয়নি। যুগ্ম সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তাদের পদায়নের আগে প্রধান উপদেষ্টার পূর্বানুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সে ক্ষেত্রে তাদের পদায়নসংক্রান্ত ফাইল প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে পাঠানো হলেও এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মাঠ প্রশাসনে ঢাকা এবং রংপুর বিভাগে কোনো বিভাগীয় কমিশনার নেই। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনাররা রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন। রাজশাহী, নাটোর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও দিনাজপুর কোনো ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ডিসি নিয়োগ দিতে গিয়ে ঘটে গেছে কেলেঙ্কারির ঘটনা। মাঝারি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুস লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে ঘুস গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে, তারা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। গঠন করা হয়েছে উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মাঠ প্রশাসনে ডিসি পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিসি জেলা পর্যায়ে ১২০টি কমিটির সভাপতি। আইনশৃঙ্খলা থেকে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সব কিছুতেই ডিসিকে তদারকি করতে হয়। সরকারের রাজস্ব আহরণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কালেক্টরেট হিসাবে ডিসি। এছাড়া স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের তদারকিও করেন ডিসি। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের সঙ্গে সস্পৃক্ত থাকলেও ১ মাসের বেশি সময় ধরে আট জেলায় ডিসি নেই।

৭ জুলাই বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচকে ভিত্তি ধরে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির জন্য কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহের নোটিশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এছাড়া প্রশাসন ক্যাডারের ৩০তম ব্যাচকে ভিত্তি ধরে উপসচিব পদে পদোন্নতির নোটিশ জারি করা হয়। উপসচিব পদে পদোন্নতির বিষয়ে একাধিকবার এসএসবির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির বিষয়ে এসএসবির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়নি বলে জানা গেছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ রয়েছে। যেসব মন্ত্রণালয়ে সচিব নেই সেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাজ স্থবির হয়ে আছে। অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ কিংবা বিদেশে প্রশিক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে স্থগিত রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ডেস্কের কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের পর ২ মাস অতিক্রান্ত হলেও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ও বিভাগই আগের সচিব থেকে সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যন্ত সবাই এখনো বহাল থাকায় সংকট কাটছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধু সচিবকে ওএসডি কিংবা বদলি করা হলেও অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপ-সচিব এবং সিনিয়র সহকারী সচিবরা আছেন বহাল তবিয়তে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com