গেল বছর আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬০.২ শতাংশই মেয়ে; সেইসঙ্গে বেশি আত্মহনন করেছে স্কুলগামীরা, ৪৪.২%।
ডেস্ক রিপোর্ট॥
গেল এক বছরে সারা দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫১৩ জন শিক্ষার্থীর আত্মহননের চিত্র উঠে এসেছে এক সমীক্ষায়।
সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এ সমীক্ষা বলছে, সবথেকে বেশি আত্মহত্যা করেছে নারী শিক্ষার্থীরা, ৬০ দশমিক ২ শতাংশ। আর শিক্ষার স্তর বিবেচনায় আত্মহত্যা বেশি স্কুলগামীদের, ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ।
শনিবার ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে ২০২৩ সালের আত্মহত্যার এই চিত্র তুলে ধরেন সংগঠনটির রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ইউনিটের টিম লিডার ফারজানা আক্তার লাবনী।
তিনি বলেন, গত বছর আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলে ২০৪ জন, নারী ৩০৯ জন। ২০২২ সালে আত্মহত্যা করেন ৫৩২ জন। এ বছর কিঞ্চিৎ কমলেও তা আশানুরূপ নয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০২৩ সালে ২২৭ জন স্কুল শিক্ষার্থী (৪৪.২০%) আত্মহত্যা করেন। কলেজ শিক্ষার্থী রয়েছেন ১৪০ জন (২৭.২%), বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৯৮ জন (১৯.১%) এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ৪৮ জন (৯.৪%)।
কোন বিভাগে কত
ঢাকা বিভাগে ১৪৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৯ জন, রাজশাহী বিভাগে ৭৭ জন, খুলনা বিভাগে ৬৪ জন, বরিশাল ও রংপুর বিভাগেই ৪৩ জন করে, ময়মনসিংহে ৩৬ জন ও সিলেটে ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।
এগিয়ে নারীরা
২০২৩ সালে আত্মহনন করা মোট শিক্ষার্থীর ৬০.২% মেয়ে। তাদের আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৮.৮% আত্মহত্যা করেন অভিমানে, ১৬.৫% প্রেমঘটিত কারণে, ৮.৪% মানসিক ভারসাম্যহীনতায়, ৭.১% পারিবারিক কলহে, ৩.৯% যৌন হয়রানি, ৪.২% পড়ালেখার চাপে ও অকৃতকার্য হয়ে, ১.৬% পারিবারিক নির্যাতনে, ০.৬% অপমানে এবং ২.৯% কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে আত্মহত্যা করেন।
আত্মহত্যার কারণ
আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, ২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে বড় কারণ অভিমান। মোট শিক্ষার্থীর ১৬৫ জন (৩২.২%) অভিমান করে, ১৪.৮% প্রেমঘটিত কারণে, ৯.৯% মানসিক সমস্যাজনিত কারণে, ৬.২% পারিবারিক কলহে, ১.৪% পারিবারিক নির্যাতনে, ৪.৫% পড়ালেখার চাপে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ৩.৫%, ১.৮% কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে, ২.৫% যৌন হয়রানি ও ০.৮% অপমান বোধ করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
বেশি আত্মহত্যা স্কুলপর্যায়ে
মোট শিক্ষার্থীর ৪৪.২% স্কুলগামী গতবছর আত্মহত্যা করেন। কলেজ শিক্ষার্থী রয়েছেন ১৪০ জন (২৭.৩%), বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ১৮ জন (১৯.১%) ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ৪৮ জন (৯.৫%)।
ঝুঁকি বেশি কিশোর-কিশোরীদের
আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, বয়ঃসন্ধিকালে নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এ সময়টাতে বেশি রাগ-অভিমানের প্রবণতাও থাকে। গেল বছরের চিত্রে দেখা যায়, ১৩-১৯ বছর বয়সী ৩৪১ শিক্ষার্থী (৬৬.৫%) আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ২২২ জনই মেয়ে; বিপরীতে ছেলে ১১৯ জন।
২০-২৫ বছর বয়সীদের আত্মহত্যার হার ২৩.৪%, ২৬-৩০ বছর বয়সী ২.৩%, আর এক-দুই বছর বয়সী শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার হার ৭.৮%।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোর বয়সে হরমোনজনিত কারণে শিক্ষার্থীরা বেশি আবেগপ্রবণ থাকে। ফলে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি থাকে।
সুপারিশ
আত্মহত্যা কমাতে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে আঁচল ফাউন্ডেশন।
>> স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি মাসে অন্তত একবার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
>> প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে মেন্টর নির্ধারণ এবং উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি।
>> শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেন্টাল হেলথ কর্নার চালু করা।
>> শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করা।
>> মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ট্যাবু ভাঙতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রচার চালু করা।
>> পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতা শেখানো।
>> যে কোনো নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে শিক্ষার্থীদের কৌশল, মানকি চাপ নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে শেখানো।
>> শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পরিবারের সদস্যদের আত্মহত্যার আলামত সম্পর্কে ধারণা বিস্তৃত করা।
>> মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ইন্সুরেন্স বীমার আওতায় আনা, যেন তা সকলের জন্য সাশ্রয়ী হয়।
>> মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে টোল ফ্রি জাতীয় হট লাইন নম্বর চালু করা।
সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. সাইদুর রহমান, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ বি এম নাজমুস সাকিব এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ উপস্থিত ছিলেন।