দেশে কর্মসংস্থান নিয়ে তরুণদের হতাশা বাড়ছেই। প্রতি বছর শ্রমশক্তিতে যোগ হওয়া নতুন মুখের তুলনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে অর্ধেক। ফলে বেড়েই চলেছে বেকারের সংখ্যা।
টিডিএস ডেস্ক॥
দেশে কর্মসংস্থান নিয়ে তরুণদের হতাশা বাড়ছেই। প্রতি বছর শ্রমশক্তিতে যোগ হওয়া নতুন মুখের তুলনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে অর্ধেক। ফলে বেড়েই চলেছে বেকারের সংখ্যা। সরকারি হিসাবে সপ্তাহে এক ঘণ্টাও মজুরির বিনিময়ে কাজ পাননি এমন নিরেট বেকারের সংখ্যাই দেশে অন্তত ২৬ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখই উচ্চশিক্ষিত, যার ২১ লাখই তরুণ-তরুণী। নিয়োগ পরীক্ষা দিতে দিতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে চাকরিতে প্রবেশের বয়স। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাবে মিলছে না পছন্দমতো বেসরকারি চাকরিও।
এমন পরিস্থিতিতে স্নতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে টিউশনি, রাইড শেয়ার, ডেলিভারিম্যান, বিক্রয়কর্মী বা চায়ের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন অনেকে। কেউ প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝুঁকছেন কৃষি বা ফ্রিল্যান্সিংয়ে। ফেসবুক-ইউটিউব চ্যানেল খুলেও আয়ের চেষ্টা করছেন অনেকে। আবার উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন বছরে অন্তত ৫০ হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। তাদের অধিকাংশই আর ফিরছেন না।
সর্বশেষ ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, তখন দেশে বেকারের মোট সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৮২ হাজার, যার ৫১ ভাগই কমপক্ষে উচ্চমাধ্যমিক পাস এবং ৮৩ ভাগই তরুণ-তরুণী। ২০১৭ সালে উচ্চশিক্ষিত বেকার ছিল ৪ লাখ ৫ হাজার, যা ২০২২ সাল শেষে বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৯৯ হাজারে। এর মধ্যে প্রতি বছর শ্রমবাজারে ২০-২২ লাখ তরুণ জনগোষ্ঠী নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। সেই বিবেচনায় হচ্ছে না সরকারি-বেসরকারি নিয়োগ। সরকারি চাকরিতে শূন্য পদ রয়েছে ৫ লাখের বেশি।
প্রতি বছর গড়ে নিয়োগ হচ্ছে মাত্র ৭১ হাজার। বিনিয়োগের অভাবে বেসরকারি খাতেও সৃষ্টি হচ্ছে না পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান। ২০১৯ সালে একটি গণমাধ্যমের জরিপে দেখা যায়, তরুণদের ৭৮ শতাংশই নিজেদের কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন, যা উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে আরও বেশি (৯১ শতাংশ)। গত ৫ আগস্ট সরকারের পতন ঘটানো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পেছনেও ছিল চাকরি পাওয়া নিয়ে হতাশা।
এদিকে, সরকারি চাকরিতে প্রচুর শূন্য পদ থাকলেও হচ্ছে না নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, সরকারি অফিসগুলোতে প্রায় ৫ লাখ ৩ হাজার ৩৩৩টি শূন্য পদ আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে গত তিন মাসে স্থগিত করা হয়েছে সরকারি চাকরির অর্ধশতাধিক নিয়োগ পরীক্ষা। কভিড-১৯ বিধিনিষেধের কারণে দীর্ঘদিন নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকার পরও এখনো তা স্বাভাবিক হয়নি।
অন্যদিকে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর বছর ঘুরলেও হয়নি অনেক নিয়োগ পরীক্ষা। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শন (সেফটি) ৪১টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় ২০১৯ সালে। কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষা হয়নি। এরপর ২০২৩ সালের ২৬ জুন আবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে পিএসসি। এরপরও নিয়োগ পরীক্ষা হয়নি। এর মধ্যে প্রতি বছর শ্রমবাজারে নতুন মুখ যোগ হওয়ায় চাকরি পেতে প্রতিযোগিতাও বাড়ছে। বিসিএস পরীক্ষায় প্রতিটি পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন অন্তত ২০০ জন। সর্বশেষ ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষায় ১ হাজার ১৪০টি পদের বিপরীতে প্রাথমিক আবেদন জমা পড়ে ৩ লাখ ৩৮ হাজার।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে পাঁচ বছরে সরকারি চাকরির হিসাব দেন। তার হিসাব অনুসারে ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত (পাঁচ বছর) দেশে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ২৩৭টি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতি বছর গড়ে ৭১ হাজারের মতো সরকারি চাকরি হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর শিক্ষিত নতুন শ্রমশক্তির তুলনায় সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হচ্ছে নামমাত্র।
এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, সরকারি অফিসগুলোতে শূন্য পদে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া হবে। অন্যান্য দপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয় না। অন্তর্বর্তী সরকার দেশের একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই পিএসসি পুনর্গঠন করা হবে। এরপর বিসিএস পরীক্ষাসহ পিএসসির সব নিয়োগ দ্রুত সম্পন্ন করা হবে।
এদিকে, কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পেয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের পেছনে ঝুঁকছে তরুণ সমাজ। তথ্য-প্রযুক্তিসহ অন্যান্য দক্ষতা অর্জন করে অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং করছেন। দেশে বসে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছেন। দেশে ফ্রিল্যান্সারের সঠিক তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি বলছে, বাংলাদেশ থেকে ১৫৩টি মার্কেটপ্লেসে কাজ করা হয় এবং ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা অন্তত ১০ লাখ।
এ ছাড়া লাখ লাখ তরুণ-তরুণী এখন ফেসবুকে ই-কমার্স ব্যবসা, এমনকি ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে আয় করছেন বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। উচ্চশিক্ষা শেষ করে অনেকে এখন মাশরুম, পেঁপে, মাছ চাষসহ কৃষিতে ঝুঁকছেন। গড়ে তুলছেন গবাদি পশুর খামার। আবার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান না হওয়া, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কারণে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন অনেক শিক্ষিত তরুণ।
পরিসংখ্যান বলছে, শিক্ষিত তরুণদের ৪২ শতাংশই বিদেশ যেতে আগ্রহী। এর মধ্যে বড় অংশই স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে দেশের বাইরে যেতে যান। লেখাপড়া শেষে সেখানেই থিতু হতে চান। গত বছর বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড জাস্টিস সেন্টারের ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে-২০২৩’ শীর্ষক সমীক্ষায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে। ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৯ হাজার ১৫১ জন।
সম্প্রতি দেশে ভালো বেতনের চাকরি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষায় পাড়ি দেওয়া তানজিদ বলেন, দেশে কখন চাকরি থাকে, কখন থাকে না তার নিশ্চয়তা নেই। রাজনৈতিক অস্থিরতা লেগেই থাকে। ভালো চিকিৎসার নিশ্চয়তা নেই। মূল্যস্ফীতির কারণে লাখ টাকা বেতনেও ভালো চলা যায় না। বায়ুদূষণ, যানজটসহ নানা সমস্যা। পরিবার ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবেই অনেকে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আমি উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি, অনুমতি পেলে থেকে যাবো।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বেসরকারি বিনিয়োগ এক দশক ধরে জিডিপির ২২-২৩ শতাংশে আটকে আছে। অর্থাৎ দেশে কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ সেই হারে বাড়ছে না। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত থাকছে। বিনিয়োগ না বাড়লে বেকারত্ব বাড়তেই থাকবে।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন