রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫১ পূর্বাহ্ন

দিকনির্দেশনাহীন বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ

  • আপডেট সময় শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৬.২২ পিএম
  • ১২ বার পড়া হয়েছে
ছবি: সংগ্রহীত

টিডিএস ডেস্ক॥

ঢাকা: কোটা সংস্কারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে নিজের ক্ষমতায় পেরেক ঠুকেছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। এতে ফুঁসে ওঠে ছাত্র সমাজ, তাদের সঙ্গে যোগ দেন দেশের আপামর জনতা।
দুয়ের মিলনে তৈরি হয় দেশব্যাপী সরকার হটাও আন্দোলন। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের দমনে শুরু হয় পীড়ন। চোরাগোপ্তা হামলা, স্নাইপারের গুলি, চুরি-চাকু-চাপাতির কোপ, গুম- বিশাল হত্যাযজ্ঞ। এতেই নিজের একচ্ছত্র আধিপত্যের শেষ ডাকেন হাসিনা।
নিজের স্বৈরতন্ত্র নিয়ে তিনি এতটাই বিমোহিত ছিলেন, সাধারণ মানুষ যে পদে পদে ধুকছে, তা তিনি দেখেননি। নিজের তির্যক মন্তব্য, ছাত্র থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে মানুষ না ভাবা শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচারী করে তুলেছিল। ছাত্র-জনতার এক দফা তাকে সেখান থেকে আছাড়ে মাটিতে ফেলেছে। ফলে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা ‘মাদার অব ব্রুটালিটি’ বঙ্গবন্ধু কন্য শেখ হাসিনা।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। পেছনে ফেলে যান হাজারো নেতাকর্মীকে। এ তালিকায় রয়েছে তার দলের হেভিওয়েটরাও। হাসিনার হঠাৎ পলায়ন তাদেরও ভীত করে তোলে। যে যার মতো গা ঢাকা দিয়ে নিজেদের প্রাণ রক্ষা করেন। কয়েকজন অবশ্য ধরাও পড়েছেন।
স্বৈরাচার সরকারের পতনের আজ এক মাস ২ দিন। এ কয়দিনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। দিক নির্দেশনাহীন বিপর্যস্ত অবস্থায়ই তাদের দিন কাটছে। যেকজন ধরা পড়েছে, তারা বাদে কে কোথায় আছেন তা নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। কয়েকজন বিদেশ পালিয়েছেন তা প্রকাশ্য। বাকিরা কোন গর্তে আছেন, সেটি জানতে চাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষ।
হেভিওয়েট নেতাদের সঙ্গে হেভিওয়েট কর্মীদের কয়েকজন আত্মগোপন থেকেই দেশ ছেড়েছেন, এমন তথ্য পাওয়া গেছে খোদ আওয়ামী লীগ থেকেই। একের পর এক মামলা, গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হওয়ায় দলের নেতাকর্মীরা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন। প্রায় প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মীদের নামে মামলা হয়েছে, আরও হবে এমন আতঙ্কে নিজ নিজ বিলে অবস্থান করছেন তারা, এমন খবরও সূত্র মারফত জানা গেছে।
গত ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৩৮টি। এর মধ্যে ১২৫টি মামলা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। রাজধানীসহ সারা দেশ থেকে মামলাগুলো হয়েছে। হাসিনার পাশাপাশি এসব মামলায় তার মন্ত্রিসভা ও দলের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, ‘ডামি নির্বাচনে’ নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নামেও মামলা হয়েছে।
বিভিন্ন মামলায় শেখ হাসিনার আইনমন্ত্রী, উপদেষ্টা, বাণিজ্যমন্ত্রী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। আদালতে তোলার সময় তাদের ওপর জনরোষ দেখা গেছে। তাদের লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয় পচা ডিম ও জুতা।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানিয়েছে, যারা আত্মগোপনে রয়েছেন, কতদিন থাকতে পারবেন তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভারত থেকে শেখ হাসিনা অনেককেই ভিডিও মাধ্যমে বা মোবাইল ফোনে নানা বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও কোনো কিছুর পরিবর্তন হয়নি। কেননা, ভিডিও মাধ্যমে এক নেতা দলীয় প্রধানের সঙ্গে কথা বলছেন এমন চিত্র ভাইরাল হলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। যে কারণে আওয়ামী নেতাকর্মীদের মনে আরও ভয়ের সঞ্চার হয়েছে।
বিশেষ করে গত ৪ সেপ্টেম্বর রাতে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর এ ভয় আরও বেড়েছে। বহু মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, নানা স্তরের নেতা গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন।
ফলে দল ও নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ বিপাকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এক মাস পেরিয়ে গেছে নেতাকর্মীরা এখন কী করবেন সে ধরণের কোনো দিকনির্দেশনা দলের দায়িত্বশীল কারও কাছ থেকে পাননি। দলের হয়ে এখন কথা বলা বা একটা বিবৃতি দেওয়ার মতোও কেউ নেই।
অবশ্য, দলের দুয়েকজন নেতার দুয়েকটি বিবৃতি ধরণের বক্তব্য পাওয়া গেলেও তারা অজ্ঞাত স্থানে থাকায় এসবের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। দলের অফিসিয়াল ই-মেইলও এখনো চালু হয়নি।
আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ রয়েছে। সেখানে মাঝে মাঝে কিছু তথ্য বা দুয়েকটি বিবৃতি পোস্ট করা হলেও সময়ের প্রাসঙ্গিকতা নেই। দেখা যাচ্ছে, কোনো একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার কয়েকদিন পর সংশ্লিষ্ট একটি পোস্ট শেয়ার করা হচ্ছে।
আত্মগোপনে থাকা দুয়েকজন নেতার সঙ্গে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা গেলেও তারা কোনো কোনো বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী হন না। বিশেষ করে তাদের রাজনৈতিক পথ কোন দিকে যাবে, সে ব্যাপারে কোনো শব্দ ব্যয় তারা করছেন না। প্রায় সবাই- ‘জানি না’, ‘কিছু বলতে পারছি না’ বলে জানিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, দলের সভাপতি শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা, তিনি রাজনীতি করবেন না- এ ধরণের বক্তব্যও নেতাকর্মীদের হতাশ করেছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা পালায় না, পালাবেন না- এমন মন্তব্যের পর দলের নেতাকর্মীদের ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনায় তারা বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড ওবায়দুল কাদেরও প্রকাশ্যে নেই। তিনি কোথায় আছেন, তাও কেউ জানেন না।
ওবায়দুল কাদের আত্মগোপনে যাওয়ার আগে শেখ হাসিনা ও নিজের না পালানো নিয়ে বেশ কড়া বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু দলের এ পরিস্থিতিতে দুই কাণ্ডারির অনুপস্থিতি আওয়ামী লীগে বিভাজন তৈরি করবে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।
এর আগে ১/১১ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনাকে দেশে আসতে বাধা দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে এসেছিলেন। ছাত্র-জনতার প্রবল বিক্ষোভের মধ্যে সরকার উৎখাত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের রাজনীতি বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছে বলেও মত দেন অনেকেই।
এর মধ্যে আবার কারও কারও মত, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যেতে চাননি, তাকে বাধ্য করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, দেশ ও দশের চিন্তায় তিনি নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। জীবন নিয়ে প্রতিবেশী দেশে যেতে পেরেছেন, এটাই বাস্তবতা।
ভারতে চলে যাওয়ার পর শেখ হাসিনার রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। তার ভাষ্য ছিল, হাসিনা আর কখনও রাজনীতি করবেন না। কিন্তু পর মুহূর্তেই তিনি নিজের বক্তব্য পরিবর্তন করেন। হাসিনার রাজনীতিতে ফেরা নিয়ে ইঙ্গিত দেন।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জয় বলেন, শেখ হাসিনা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। আমার মনে হয় এখানেই শেষ। আমার পরিবার এবং আমি –আমাদের যথেষ্ট হয়েছে। তিনি (শেখ হাসিনা) এতোটাই অসন্তুষ্ট যে দেশের উন্নয়নের জন্য এতো কঠোর পরিশ্রম করেছেন যেটাকে সবাই মিরাকল বলে। এরপরও একটা ছোট্ট অংশ তার বিরুদ্ধে গিয়েছে, এমন বিক্ষোভ করলো। আমি মনে করি তিনি আর এসবে নেই। আমার পরিবার ও আমিও নেই, যথেষ্ট হয়েছে।
এরপরই আবার নিজের বক্তব্যে পরিবর্তন আনেন জয়। শেখ হাসিনা ফিরবেন, তিনি নিজেও বাংলাদেশে এসে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়াবেন বলে জানান। সে ক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে তার দলের যে বিভেদ, তা শেষ করতে চেষ্টা করবেন বলেও উল্লেখ করেন জয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু তিনি আর রাজনীতি করবেন না, এ সবে নেই; এ ধরণের কথায় নেতাকর্মীরা হতাশ। এটা দলের জন্য ক্ষতি।
এর মধ্যে শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) রাতে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত না হতে পরামর্শ দেন তিনি।
নাছিম বলেন, ‘প্রিয় দেশবাসী, দেশ এক ক্রান্তিলগ্ন পার করছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। আমরা এক মগের মুল্লুকে বাস করছি। সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর অবর্ণনীয় জুলুম-নিপীড়ন নেমে এসেছে। এরপরও স্বাধীনতা বিরোধী ও ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদের নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে দিতে পারেনি। এখন তারা ছলনা ও চাতুরীর মাধ্যমে নেতাকর্মীকে বিভ্রান্ত করার পথ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে জালিয়াতি করে আওয়ামী লীগের প্যাড ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া বিবৃতি প্রদান করছে ষড়যন্ত্রকারীরা। তারা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব পরিবর্তনের গুজব ছড়াচ্ছে।
আপনারা জানেন, দলের সভাপতি শেখ হাসিনা একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ভারতে অবস্থান করছেন। তিনিই আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোনো সংগঠন নয়। আওয়ামী লীগ এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। এ দলের নেতৃত্বে আছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। ফলে কারো অপপ্রচারে আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। দলের যেকোনো সিদ্ধান্ত আপনারা দায়িত্বশীল নেতাদের মাধ্যমে জানতে পারবেন। কোনো ষড়যন্ত্রকারীদের কথায় কান না দিয়ে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করাই এখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রধান কাজ। আমরা বিশ্বাস করি শিগগিরই আঁধার কেটে যাবে। বাংলাদেশ আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে পরিচালিত হবে। ’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com