শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:১৮ অপরাহ্ন

বাড়ছে ভেজাল বিটুমিনের ব্যবহার

  • আপডেট সময় বুধবার, ১৯ মে, ২০২১, ৭.৫৭ এএম
  • ১০ বার পড়া হয়েছে
File photo

ডেস্ক রিপোর্ট॥

সড়ক, মহাসড়ক তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিটুমিন আমদানিতে মান নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) কর্তৃক মান যাচাই ছাড়াই দেশে আমদানি করা হচ্ছে ভেজাল ও নিম্নমানের বিটুমিন। অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট এসব নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি করে ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সিন্ডিকেট নিম্নমানের বিটুমিন এনে তার সঙ্গে ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি করছে। এর ফলে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের পরপরই তা অকার্যকর হয়ে পড়ছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরকারের গচ্চা যাচ্ছে শত শত কোটি টাকা। সড়কে স্বচ্ছন্দে চলার পরিবর্তে ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়মনীতি ও তদারকি না থাকায় নিম্নমানের বিটুমিন আসছে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে। আমদানিকারকদের সরকারের নির্ধারিত কোনো মান পরীক্ষার মুখেই পড়তে হয় না। তদারকি না থাকার এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেদার আমদানি করা হচ্ছে নিম্নমানের বিটুমিন। এর ফলে দেশের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সড়ক নির্মাণের পর ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে বিটুমিন গলানো, পাথরের সঙ্গে বিটুমিনের মিশ্রণে যে নিয়মনীতি মানা প্রয়োজন তা-ও ঠিকভাবে পালন না করায় সড়কগুলোর সর্বনাশ হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি করা নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহারে রাষ্ট্রের ত্রিমুখী ক্ষতি হচ্ছে। এক. বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ও মানি লন্ডারিং হচ্ছে। দুই. টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে না। তিন. অসাধু ঠিকাদার ও অসৎ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট না ভাঙায় সরকারের অর্থের অপচয় হচ্ছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট বন্দরে শুল্ক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পণ্য খালাসের (কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স) আগেই গুণগত মান সনদ (বিএসটিআই, বুয়েট, ইআরএল) যাচাই বাধ্যতামূলক করার দাবি উঠেছে। একই সঙ্গে সড়কে মানসম্মত বিটুমিন ব্যবহার নিশ্চিত করতে নির্মাণকাজে তদারকি জোরদার করারও দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দেশে ব্যবহৃত মানহীন বিটুমিন আমদানির ভয়াবহ চিত্র। দেখা গেছে, বিটুমিন যখন জাহাজে তোলা হয় তখন প্রথমে একবার হিট দেওয়া হয়। এতে বিটুমিন একবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর জাহাজ থেকে নামানোর সময় আরেকবার হিট দেওয়া হয়। তখন আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার ড্রামে ভরার সময় আরেকবার হিট দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এইভাবে বারবার হিট দেওয়ায় বিটুমিনের শক্তি বা পেনিট্রেশন কমে যায় বা পাতলা হয়ে যায়।

শুধু তা-ই নয়, জাহাজ থেকে ড্রামভর্তি বিটুমিন বন্দরে আনার পর যাচ্ছেতাইভাবে রাখা হয় শেডে। গোডাউনের শেডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে খোলা আকাশের নিচে ময়লা, কাদার মধ্যেই অবৈজ্ঞানিকভাবে রাখা হয় আমদানি করা বিটুমিন।

অনুসন্ধানে আরো দেখা যায়, নিম্নমানের বিটুমিন দেখতে ধূসর রঙের হয়ে থাকে। এর সঙ্গে গিলসোনাইড নামের এক ধরনের কেমিক্যাল মিশিয়ে এসব বিটুমিন কালো করা হয়ে থাকে। পাতলা বিটুমিনকে ঘন করার জন্য ব্যবহার করা হয় মাটি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিটুমিনের ড্রামে ভেজাল মেশানোর ৮ থেকে ১০টি কারখানা রয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৫ সালে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার বন্ধে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেখানে বলা হয়, রাস্তার কাজে ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের উন্নত মানের বিটুমিন ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় ঠিকাদাররা আমদানি করা নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করছেন। তবে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা কিংবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তা নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। সড়ক কার্পেটিং ও তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোও বরাবরের মতোই নিশ্চুপ।

জানা গেছে, দেশে বর্তমানে বিটুমিনের বার্ষিক চাহিদা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে দেশে বিটুমিনের বাজার প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার। সেখানে উপজাত হিসেবে মাত্র ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন বিটুমিন সরবরাহ করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। এটি মোট চাহিদার ১৩ শতাংশেরও কম। বাকি বিটুমিনের জন্য দ্বারস্থ হতে হয় আমদানিকারকদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত মানের ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন দিয়ে রাস্তায় পিচ ঢালাই দিলে সেই রাস্তা দু-তিন বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। অথচ আমাদের দেশের রাস্তাগুলো এক বছরও টেকে না। প্রতিবছর বর্ষার পরপরই দেশের প্রায় সব সড়ক ও মহাসড়ক সংস্কার করতে হয়। আবার পিচ ঢালাইয়ের পর ছয় মাসও সড়ক টেকে না—এমন নজিরও আছে দেশে। এর প্রধান কারণ আমদানি করা অতি নিম্নমানের বিটুমিন। এই বিটুমিন একদিকে অল্প তাপে গলে যায়, অন্যদিকে বর্ষার পানিতেও আঠা নষ্ট হয়ে যায়।

বিটুমিন বিশেষজ্ঞ আইইউটির সহকারী অধ্যাপক ড. নাজমুস সাকিব বলেন, ‘দেশের বেশির ভাগ রাস্তা ঢালাইয়ের পর দেখা যায়, বিটুমিন থেকে পাথর আলাদা হয়ে গেছে। এর মূল কারণ বিটুমিনের সঙ্গে পাথরের লেগে থাকার জন্য যে আঠার প্রয়োজন তা নেই। এই চরিত্রটা আমদানি করা নিম্নমানের বিটুমিনে দেখা যায়। এ ছাড়া আমদানি করা বিটুমিনের উৎপাদন উৎস কোথায় তা আমরা কেউ বলতে পারি না। ফলে এসবের মান সব সময় আকাশ-পাতাল পার্থক্য হওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে।’

ড. নাজমুস সাকিব আরো বলেন, ‘এমন একটা শিপ থেকে আমরা বিটুমিন নিচ্ছি যেটি তিন-চার মাস সাগরে ভাসছে। এই বিটুমিনের মধ্যে আমদানিকারকরা বেশি মুনাফার আশায় শিপের স্লাজ, ইঞ্জিন অয়েল ইত্যাদি মেশায়। মূলত চোরাইভাবে কিংবা মানহীনভাবে তৈরি বিটুমিনগুলোই বাংলাদেশে এসে পৌঁছাচ্ছে। এসব আবর্জনাকে বিটুমিন নামে আমরা আমাদের রাস্তায় ব্যবহার করছি। হাজার হাজার কোটি টাকার সড়ক ও মহাসড়ক ফিনিশিং দিচ্ছি আবর্জনা দিয়ে।’ তিনি আরো বলেন, বিএসটিআইয়ের অনুমোদনহীন নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহারের ফলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রাস্তা নির্মাণের পর ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে  যাচ্ছে। এ ছাড়া আমদানি করা মানহীন এসব বিটুমিন ব্যবহারের কারণে দেশে আরো বড় আকারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) বিভাগের অধ্যাপক শামছুল হক  বলেন, নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করার কারণে রাস্তা টেকসই হচ্ছে না, এটা অবশ্যই সঠিক। তিনি ভালো মানের বিটুমিন দিয়ে রাস্তা নির্মাণের পরামর্শ দেন সরকারকে।

বিশাল চাহিদার এই বিটুমিন বৈধভাবে আমদানি ও বাজারজাত করার জন্য বিইআরসি থেকে লাইসেন্স নিয়েছে দেশের শতাধিক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া অবৈধ প্রক্রিয়ায় বিটুমিন আমদানি ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও অনেক। তারা বৈধ আমদানিকারকদের ভুয়া চালান ব্যবহার করে রাস্তা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে কম দামে নিম্নমানের বিটুমিন সরবরাহ করে। আবার যারা বিটুমিন আমদানির বৈধ লাইসেন্সধারী, তারাও অতি মুনাফার আশায় নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি করে।

ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আকতারুল হক বলেন, নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি এখনই বন্ধ করতে হবে। যারা রাস্তায় কাজ করে, তারা দেখানোর জন্য ভালোটা সামনের দিকে রাখে, নিম্নমানেরটা ভেতরের দিকে রাখে। সে জন্য যাঁরা হাইওয়ে কাজ করান তাঁদেরও অনেক দায়িত্ব আছে। ঠিকাদারদের না দিয়ে নিজেরাই স্যাম্পল সংগ্রহ করে পরীক্ষা করাতে হবে। দাম কম পাওয়াতে ঠিকাদাররা আমদানিকারকদের কাছ থেকেই বিটুমিন কিনে নিচ্ছে। আসলে বিটুমিনের দামের চেয়ে অপ্রত্যক্ষ ক্ষতিই অনেক বেশি। তাই আমদানি করার ক্ষেত্রে বিটুমিনের মান নিশ্চিত করতে হবে এবং মনিটরিং আরো বাড়াতে হবে। বিটুমিন আসার পরেও যাতে কোনো মিক্সিং না হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। এ বিষয়গুলো যদি না মানা হয়, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

বিটুমিন আমদানিকারক আর ঠিকাদারদের অনিয়ম ও জালিয়াতির বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে অনুসন্ধানে। ভেজাল বিটুমিনের সঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো অসদুপায় অবলম্বন করে বিটুমিনের সঙ্গে গিলসোনাইট নামের এক ধরনের কেমিক্যাল মিশ্রণ করে বিটুমিনের পরিমাণ বৃদ্ধি করছে। ঠিকাদারসহ অসাধু সিন্ডিকেট লাভবান হলেও ঠকছে সরকার ও সাধারণ মানুষ। কারণ ওই গিলসোনাইট কেমিক্যাল বিটুমিনের সঙ্গে মেশানোর কারণে বিটুমিনের বন্ডিং (বিটুমিনের কংক্রিট ধারণ) ক্ষমতা কমে যায়। গুণগত মানে পাতলা ও বন্ডিংক্ষমতা কম হওয়ায় গ্রীষ্মকালে এ ধরনের নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহৃত সড়কগুলো গলে ঢেউয়ের আকার ধারণ করে। সৃষ্টি হয় অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত। আবার বৃষ্টির সময় বিটুমিন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সড়কের এসব অংশে পানি জমে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় এবং খানাখন্দের সৃষ্টি হয়।

চুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও ট্রান্সপোর্টেশন বিশেষজ্ঞ ড. মাহমুদ ওমর ইমাম  বলেন, নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহারের ফলে তিন বছর মেয়াদি রাস্তা ছয় মাস না যেতেই কার্পেট উঠে যায়। প্রতিবছর বর্ষার পরেই সংস্কার করতে হচ্ছে। এতে সবচেয়ে ভোগান্তি হয় মানুষের। তাই এখনই সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বোঝা উচিত, ভালো বিটুমিন ব্যবহার করতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে এবং অনেক কিছু থেকে সাশ্রয়ী হওয়া যাবে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com