শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১১:১৭ অপরাহ্ন

সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি মামলা চেক প্রতারণায়

  • আপডেট সময় সোমবার, ২১ নভেম্বর, ২০২২, ১১.১৭ এএম
  • ৮ বার পড়া হয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার॥
প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে চেক প্রতারণার মামলা। এ রকম মামলার সংখ্যা প্রচুর হওয়ায় বিচার পেতে বিলম্ব হয় বিচারপ্রার্থীদের। আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চেক প্রতারণার মামলা দায়ের হলেও বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষমতা না থাকায় এ মামলাগুলোর বিচার ও নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা রয়েছে কেবল মহানগর দায়রা জজ কিংবা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের। অন্যদিকে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমাতে শুধু চেক প্রতারণার মামলা বিচারের জন্য আলাদা আদালতের ব্যবস্থা কারার জন্য দাবি জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

চেক প্রতারণার (এনআই অ্যাক্ট) দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা এখন সাড়ে পাঁচ লাখেরও বেশি। এনআই অ্যাক্টের মামলা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য ফৌজদারি মামলা। তৈরি হচ্ছে আর্থসামাজিক অস্থিরতা, টানাপড়েন ও পারিবারিক অশান্তি। চেক প্রতারণার মামলায় আত্মহত্যা, হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইনস্ট্রোক করে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
আইনজীবীরা বলছেন, চেক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব একটি বড় সমস্যা। চেক প্রতারণার ঘটনায় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে মামলার সংখ্যা। সারা দেশের আদালতে সাড়ে ৩৫ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন। নিম্ন আদালতে রয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি চেক প্রতারণার মামলা। এসব মামলায় বিচার চেয়ে বাদীরা বছরের পর বছর ধরে আদালতে ঘুরছেন। বিচারপ্রার্থীরা বলছেন, মামলা শুনানির জন্য বছরে একটি তারিখ ধার্য করা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি।
অন্যদিকে ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের ঋণ প্রদানের সময় কৌশলে ব্ল্যাঙ্ক চেক রাখে। ঋণের কিস্তি পরিশোধে কিছুটা বিলম্ব হলে তারা গ্রাহকের চেকে ইচ্ছেমতো টাকার অঙ্ক বসিয়ে চেক প্রতারণার মামলা করে থাকে। আইনজীবীরা বলছেন, চেক ডিজঅনারের মামলার জন্য নির্দিষ্ট আইন থাকলেও তা দুর্বল। বিচারপ্রার্থীর কোনো কাজে আসে না।
আদালত থেকে দীর্ঘ সময় নিয়ে তারিখ দেওয়ায় বছরের পর বছর ধরে বিচারাধীন থাকছে মামলা। এতে বাড়ছে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি। ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বরের আগে চেক প্রতারণার মামলাগুলো যুগ্ম জেলা কিংবা যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ ব্যতীত অতিরিক্ত জেলা জজ, অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এবং বিশেষ জজ আদালতে বিচারকাজ চলত। কিন্তু ৭ ডিসেম্বরের পর চেক প্রতারণার মামলার বিচার শুধু যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে হবে বলে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক বর্তমানে এ মামলাগুলোর বিচারকাজ যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে চলে। আর যুগ্ম দায়রা জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপিল আবেদন করা যাবে। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজসহ অন্যান্য আদালতে বিচারধীন মামলাগুলো যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে পাঠানোর ফলে বিচারকাজে আরও ধীরগতি নেমে আসে। এ আদালতগুলোতে চলমান অন্যান্য মামলাগুলো নিষ্পত্তিতেও ধীর গতি নেমে আসে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নভেম্বর মাস পর্যন্ত ঢাকার আদালতে প্রায় এক লাখ ২৩ হাজার চেক জালিয়াতির মামলা বিচারাধীন। ঢাকার সাতটি যুগ্ম মহানগর ও সাতটি যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চেক প্রতারণা মামলার বিচার হয়ে থাকে। ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে শতাধিক ব্যক্তি চেক জালিয়াতির ফাঁদে পড়ে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে। এভাবে প্রতি বছর ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ মামলার জালে আটকা পড়ে থাকছে। গত বছর এসব আদালতে ৩৮ হাজার মামলা করে প্রতারিতরা। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৩৫ হাজারের মতো নতুন মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজার মামলাই চেক প্রতারণার।
ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আফসার আলী শেখ পাঁচ লাখ টাকার একটি চেক জালিয়াতির মামলা করেছিলেন ২০১৩ সালে। তার কাছ থেকে পুরোনো একটি গাড়ি ক্রয় করেছিলেন আতিক নামের এক ব্যক্তি। কিছু টাকা নগদে পরিশোধ করলেও দুই লাখ টাকার একটি চেক দেন আফসার আলীকে। চেকটি তার অ্যাকাউন্টে জমা দিলে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় তা ডিজঅনার হয়। এ বিষয়ে আতিককে আইনজীবীর মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিস দিলেও টাকা পরিশোধ না করে তিনি যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ফলে ওই বছর আতিকের বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির মামলা করেন আফসার আলী। গত আট বছরেও মামলাটির বিচার শেষ হয়নি।
এ ছাড়া সাংসারিক অনটনে পড়ে স্থানীয় একটি এনজিও থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন রাজধানীর কেরানীগঞ্জের গৃহবধূ নিশাত সুলতানা। জামানত হিসেবে তার কাছ থেকে রাখা হয়েছিল একটি ব্ল্যাঙ্ক চেক। এ ছাড়া শনাক্তকারী হিসেবে তার ননদ ফাহমিদার কাছ থেকেও একটি ব্ল্যাঙ্ক চেক নিয়েছিল এনজিওটি। প্রতি মাসে কিস্তির মাধ্যমে তিনি এনজিওকে চার লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছিলেন। তা ছাড়া সুদের টাকা পরিশোধের জন্য তার স্বামী এনজিওর নামে একটি জমি লিখে দেন। এর মধ্যে করোনাকালে বাকি ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তার এবং তার ননদের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি চেক জালিয়াতির মামলা করা হয়। তারপর এক দিন তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে বাসায় হাজির পুলিশ। পাঁচ লাখ করে মোট ১০ লাখ টাকা দাবি করে মামলা দুটি করে এনজিও। টাকা নেওয়ার সময় কথা ছিল কিস্তি পরিশোধ হলে চেক ফেরত পাবেন। যদিও কোনো লিখিত চুক্তি ছিল না। কিন্তু এনজিওর নামে স্থানীয় সুদ কারবারিরা প্রতারণা করে তার সঙ্গে। ঋণের তিনগুণ টাকা শোধ করলেও ফেরত পাননি চেক।
আইনজীবী পলাশ বাইদা জানান, চেক প্রতারণা (এনআই অ্যাক্ট) মামলার আইনটি ১৮৮১ সালের একটি পুরোনো আইন। বর্তমান সময়ে আইনটিকে সংশোধন করে আরও যুগোপযোগী করা উচিত।
আইনজীবী শাহ মাহাদী জানান, চেক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবও একটি বড় সমস্যা। অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকা সত্ত্বেও তারা চেক প্রদান করে। আর এতে করে চেক প্রতারণার মামলা হয়ে থাকে। কোনো কোনো দিন আদালতে এক দিনে চেক প্রতারণার ছয় থেকে সাতশ মামলা শুনানির জন্য দিন ধার্য থাকে। মামলার সংখ্যা বেশি হওয়ায় দীর্ঘ সময় পর শুনানির তারিখ পড়ে। এভাবে বিচার পেতে বিলম্ব হয় বিচারপ্রার্থীদের।
ঢাকা মহানগর পিপি আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘এ মামলা নিষ্পত্তি হয় ধীরগতিতে। চেক ডিজঅনার মামলার রায় হলেও বাদী তার টাকা ফেরত পান না। রায়ে অর্থ দন্ডের পাশাপাশি কারাদন্ড প্রদান করা হয়। অনেক সময় দেখা যায় আসামি কারাদন্ড ভোগ করে বের হয়ে গেছে। সেই ক্ষেত্রে তাকে আর ধরা যায় না। পরবর্তীতে টাকা আদায়ের জন্য ডিসি অফিসে সার্টিফিকেট মামলা করতে হয়। এ ছাড়া অনেক আসামি পলাতক থাকায় তাদের খুঁজেও পাওয়া যায় না। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চেক প্রতারণার (এনআই অ্যাক্ট) বেশ কিছু সংশোধনীসহ আইন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায় আইন কমিশন। পাঁচ বছর হতে চললেও সেই সংশোধনী বাস্তবায়ন হয়নি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com