এফবিডি ডেস্ক॥
‘২০১২ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে গত দশটা বছর রেলকে সেবা দিয়ে গিয়েছি। কিন্তু চলতি মাস শেষে সে চাকরি আর থাকছেনা। আমরা এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় যাবো? চাকরির বয়সও নেই, কে আমাদের চাকরি দেবে?’, মঙ্গলবার সিআরবি চত্বরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন রেলের অস্থায়ী শ্রমিক হাবিবুর রহমান।
চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত পরিচালন বাজেট সমন্বয় সভার সিদ্ধান্ত মতে, অস্থায়ী রেল কর্মচারীদের বিদায় করে দেওয়া হচ্ছে। অস্থায়ী কর্মীদের ব্যয় অফিসভিত্তিক কোডের (শ্রমিক অনিয়মিত মজুরি) পরিবর্তে আউটসোর্সিং খাত থেকে করা হবে।
গত ৩০ জুন ১৫-২০তম গ্রেডের ৯৪ জন অস্থায়ী কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের হিসাব বিভাগ।
তাদের একজন দোলোয়ার হোসেন (৪৫)। তিনি বলেন, ‘চাকুরিচ্যুত করার সিদ্ধান্তের পর থেকে গত পাঁচমাস বেতন দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু কর্মকর্তারা তাদের প্রয়োজনমতো কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। আমরা কিভাবে বেঁচে আছি রেলের কোনো কর্মকর্তা সে খবরও নিচ্ছেনা। এই শেষ বয়সে চাকরি হারালে আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকবে না।’
রেলওয়ের অস্থায়ী শ্রমিকরা ক্যাটাগরি ভেদে দৈনিক ৫০০ টাকা, ৫৫০ টাকা এবং ৫৭৫ টাকা হিসেবে বেতন পেয়ে থাকেন।
রেলওয়ে অস্থায়ী (টিএলআর) শ্রমিক পরিষদের সদস্য সচিব মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ রেলওয়েতে কখনোই আউটসোর্সিং ছিলো না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে উৎকোচ গ্রহণের উদ্দেশ্যে টিএলআর বাতিল করে আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এ অবস্থায় বেকারত্বের আশঙ্কা মাথায় নিয়ে চরম মানসিক অশান্তিতে দিনযাপন করতে হচ্ছে অস্থায়ী শ্রমিকদের।’
জনবল সংকটে রেলসেবায় বিপর্যয়ের শঙ্কা
রেলওয়েতে বর্তমানে কর্মরত আছেন ২৪ হাজার ৯৩৩ জন, যা চাহিদার তুলনায় ৪৮ শতাংশ কম। জনবল সংকট সামাল দিতে গত ১০ বছরে টেম্পোরারি লেবার রিক্রুটমেন্ট (টিএলআর) পদ্ধতিতে ৬ হাজার ৮২৯ হাজার কর্মচারীকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয় রেলওয়ে। নিয়ম অনুযায়ী, ৩ বছরের অধিক অভিজ্ঞতার শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করার নিয়ম থাকলেও উল্টো চলতি মাস (৩১ ডিসেম্বর) থেকে তাদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে।
রেল কর্মকর্তারা বলছেন, টিএলআর কর্মীরা অস্থায়ী হলেও গত ১০ থেকে ৮ বছর ধরে কাজ করে তারা রেলের বিভিন্ন দপ্তর ও অপারেশনাল কাজ পরিচালনায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করেছে। এ অবস্থায় পুরনো ও দক্ষ টিএলআর কর্মীদের বাদ দিয়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত সেবা বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
জানতে চাইলে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী বলেন, ‘রেলে এমনিতেই কর্মচারীর ঘাটতি রয়েছে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগের কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। কারা কিভাবে শ্রমিক সরবরাহ করবে তাও স্পষ্ট নয়। এ অবস্থায় বিপুল সংখ্যক অস্থায়ী শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতির কারণে রেলের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটবে।’
একই মত দেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার।
তারা কে বলেন, ‘রেলওয়ে একটি বিশেষায়িত খাত। পুরনো ও দক্ষ কর্মীদের ছাঁটাই করা হলে রেলের দৈনন্দিন কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটবে।’
রেলের এই কর্মকর্তারা জানান, বিশেষত রেলওয়ের ওয়ার্কশপ, মেকানিক্যাল, সিগন্যাল ইলেকট্রিক্যাল, ট্রান্সপোর্টস, গেটকিপার, পোর্টার, অপারেটিং পরিচালনার কাজে দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন; আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল পাওয়া না গেলে বিপর্যয় নেমে আসবে পুরো রেল খাতে।
এ বিষয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়ে গত ১৩ জুন রেল সচিব বরাবর একটি চিঠি দিয়েছিলেন রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক ডিএন মজুমদার।
চিঠিতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক ডিএন মজুমদারের লেখেন, ‘বিশেষায়িত ও কারিগরি বিভাগ হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিদ্যমান অনিয়মিত শ্রমিকদের পরিবর্তে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে সেবা গ্রহণের পদ্ধতি গৃহীত হলে সুষ্ঠু ও নিরাপদ ট্রেন পরিচালনা ব্যহত তথা সরকারী স্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে।’
রেলওয়ে শ্রমিক লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির বলেন, ‘রেলের স্বার্থ ও মানবিক বিবেচনায় আমরা শুরু থেকেই বলছি আউটসোর্সিং চাই না। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোক নিয়োগ দিলে কর্মীদের উপর রেল কর্তৃত্ব হারাবে; এতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।’
উল্লেখ্য, আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা ২০১৮ এর ৩(৩) ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, গোপনীয়তা ও সরকারি স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে কিংবা আউটসোর্সিং এর সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দক্ষ বা বিশেষায়িত সেবা বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি অতিমাত্রায় বিদ্যমান, এরূপ সেবা সমূহ অর্থ বিভাগের সম্মতি সাপেক্ষে আউটসোর্সিং নীতিমালার আওতায় বহির্ভূত রাখা যাবে।
জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান বলেন, ‘আউটসোর্সিং এর সিদ্ধান্তটা সরকারের। তাই এর লাভ বা ক্ষতি সরকারই নির্ধারণ করবে। আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে জনবল নিয়োগ করতে আরও দুই থেকে তিনমাস সময় লাগবে। আপাতত অস্থায়ী শ্রমিকদের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে। আমাদের চেষ্টা থাকবে পুরোনো শ্রমিকরাই যেন নিয়োগ পায়।’