সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২২ অপরাহ্ন

মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে ফের গোলাগুলি, এপারে আতঙ্ক

  • আপডেট সময় সোমবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০২৪, ১১.২৮ এএম
  • ২৩ বার পড়া হয়েছে
ছবি: সংগ্রহীত

এ বছরের শুরু থেকেই মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে তুমুল লড়াইয়ের খবর দেয় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।

ডেস্ক রিপোর্ট॥

সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে দেশটির সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যে আবার প্রচণ্ড গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় এপারে কক্সবাজারের টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষংছড়ির বাসিন্দারা রয়েছেন আতঙ্কে।

তুমুল লড়াইয়ের মধ্যে শনিবার টেকনাফের সীমান্তবর্তী এক বাড়ির দেয়ালে গুলি লেগেছে। এরপর থেকে এলাকাবাসীদের মধ্যে ভয় আরও বেড়েছে। সীমান্তের ওপারে গত কয়েকদিনে সংঘর্ষ বাড়ায় ও উত্তেজনা তৈরির হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিজিবির পক্ষ থেকে সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকার কথা বলা হয়েছে।

স্থানীয়রা বলছেন, টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া, তুলাতুলি ও কাঞ্জরপাড়া সীমান্ত, উখিয়া উপজেলার পালংখালির আনজুমান পাড়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা তুমব্রু ও ঘুমধুম এলাকায় বেশি গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

বাসিন্দারা সীমান্তের কাছে হেলিকপ্টার উড়তে দেখেছেন। ভারী মর্টার শেলের শব্দও তারা শুনতে পাচ্ছেন। আতঙ্কে থাকার কথা বলেছেন ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারাও।

তবে অভয় দিলেও সতর্ক থাকার পরামর্শ স্থানীয় প্রশাসনের। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, “সীমান্তের কাছাকাছি মিয়ানমারের ওপারে গোলাগুলির শব্দের ঘটনাটি শুনেছি। তবে এ ঘটনায় ভয়ের কোনো কারণ নেই। সেটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরের ঘটনা। সীমান্তে বসবাসকারীদের সর্তক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।”

২০২২ সালের অগাস্টের শেষ ও সেপ্টেম্বরের শুরুতে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। অনেক মানুষ আতঙ্কে সীমান্ত ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। তখন দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে এর প্রতিবাদ, নিন্দা ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল ঢাকা।

এই অবস্থার মধ্যে এ বছরের শুরু থেকেই মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে তুমুল লড়াইয়ের খবর দেয় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। এসব প্রতিবেদনে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দখলে থাকা অনেক শহর ও এলাকা বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে বলেও বলা হয়। দিন দিন দুপক্ষের মধ্যে লড়াই আরও তীব্র হচ্ছে।

বাংলাদেশের পাশে অবস্থিত মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) লড়াই চলছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে। এর রেশ এসে পড়েছে এপারের জনগোষ্ঠীতেও।

টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা বলেন, তারা গত এক সপ্তাহ ধরেই এমন গোলাগুলির খবর পাচ্ছেন। তবে গত দুদিন ধরে এর তীব্রতা বেড়েছে। ওপারের গোলাগুলির শব্দে এপারে সবার মধ্যে বিরাজ করছে উৎকণ্ঠা।

এই অবস্থায় সেখানে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে বলে জানান টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২০১৭ সাল থেকে পরিবার নিয়ে বসবাস মোহাম্মদ আলম।

তিনি বলেন, “কয়েক দিন ধরে ওই রাজ্যের একাধিক গ্রামে বিমান হামলা চালিয়ে আসছে জান্তা সরকারের সেনারা। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের কাছ থেকে রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নিতে অনেক গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে অনেক রোহিঙ্গার হতাহতের খবর আসছে আমাদের কাছে।

“একসময় অবৈধ সিম ব্যবহার করে কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিতেন। এখন ওখানে সিম ব্যবহার করা একেবারে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। অন্য দেশের সিম ধরা পড়লে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হচ্ছে।”

হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, শনি ও রোববার উলুবনিয়া সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির ঘটনায় সীমান্তের কাছে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। দিনে ও রাতে থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ এপারে ভেসে আসছে।

রোববার দুপুরের দিকে হোয়াইক্যং উলুবনিয়া ও উত্তর পাড়া সীমান্তের কাছে কয়েকটি হেলিকপ্টারও উড়তে দেখেছেন এই ইউপি চেয়ারম্যান।

উখিয়ার পালংখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন বলেন, “আনজুমান পাড়া সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে চলমান গোলাগুলির ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

“দুপুরে দিকে দেখা গেছে, দুটি হেলিকপ্টার থেকে গোলা ও বোমা ছোড়া হচ্ছে। স্থানীয়রা ভয়ে এখন চিংড়ি ঘের ও জমিতে যেতে পারছেন না।

এ ঘটনায় নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছে চেয়ারম্যান গফুর। তিনি বলেন, “সেই সঙ্গে বিদ্রোহীরাও ঢুকতে পারে। তবে এ ব্যাপারে বিজিবিসহ স্থানীয়রা সর্তক রয়েছেন।”

ঘুমধুমে সবাই সতর্ক, তবে ‘আতঙ্ক নেই’

স্থানীয় জনপ্রনিধিরা বলছেন, সীমান্তের ওপারে বড় উত্তেজনার মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ি তুমব্রু সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের বিজিবির পক্ষ থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, এখানে মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় গুলাগুলি নিয়মিত ঘটনা হয়ে পড়েছে। কয়েক দিন পর পর প্রায় ঘটে। এটা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে আগের এত আতঙ্ক নেই। তবে সবাই সতর্কভাবে রয়েছে।

এসব সীমান্ত এলাকাজুড়ে বিজিবি ও গোয়েন্দাদের নিয়মিত টহল, সতর্কতা রয়েছে। তবে বিজিবির পক্ষ থেকে স্থানীয়দের সীমান্তের কাছাকাছি না যেতে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে বলেও জানান চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ।

ঘুমঘুম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, চার-পাঁচ দিন আগেও বাইশফাঁড়ি এলাকার তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের কিছু লোকজন পালিয়ে তুমব্রু এলাকায় আসছিল। পরে বিজিবির পক্ষ থেকে তাদের কোনাপাড়া এলাকায় থাকতে বলা হয়েছিল।

“তবে এতদিনে তারা চলে যাওয়ার কথা। কারণ গোলাগুলির ঘটনা টেকনাফ, হোয়াইক্ষ্যং এলাকার দিকে, মিয়ানমার সীমান্তের ভেতরে। সেখানে বিশাল বিশাল আওয়াজে বোমার শব্দ শুনা যাচ্ছে সবসময়।”

ইউপি সদস্য বলেন, “শনিবার নীলা এলাকা বিশাল বিশাল বোমার আওয়াজে কেঁপে ওঠে। মনে হচ্ছে, আমাদের এখানেই ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আমাদের এখানে কোনো কিছু ক্ষতি হচ্ছে না। কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আপাতত কোনো ভয়-টেনশন কিংবা আতঙ্কও নেই। সীমান্তের ওপারে তাদের মধ্যে গোলাগুলি চলছে।

বাইশফাঁড়ি এলাকা ঘুমধুম ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে।

ওই ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ আলমের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও নেটওয়ার্ক পেলেও এলাকাটি এখনও মোবাইল নেটওয়ার্কবিহীন। মিয়ানমারে পক্ষ থেকে তাদের সীমান্তজুড়ে কাঁটাতার দেওয়া রয়েছে।

এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ির ইউএনও মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, “মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় আমাদের এখানকার লোকজন স্বাভাবিক কারণে একটু ভয় পাবেন। অনেক সময় আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে বের হয়ে পড়েন।

“তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বিজিবি, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে। সবাই তৎপর ও সোচ্চার রয়েছেন।”

তিনি বলেন, “জনপ্রতিনিধিদের বলা আছে, একেবারে বড় কিছু হলে নিরাপদ স্থানে এসে আশ্রয় নিতে। সীমান্ত এলাকা; স্বাভাবিকভাবে বিজিবি কাজ করছে। এখনও পর্যন্ত বড় কোনো রিপোর্ট আসেনি। মিয়ানমারে যা ঘটছে সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনা। সীমান্তের এলাকা হওয়ায় আমাদের স্থানীয় বাসিন্দাদের ভয়ের কাজ করতে পারে।”

সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের এ ঘটনায় রোহিঙ্গাদের চলাচলের ব্যাপারে সবাই সতর্ক রয়েছে জানিয়ে ইউএনও বলেন, শনিবার বাইশফাঁড়ি এলাকায় ২৩ বছর বয়সী একজন রোহিঙ্গা যুবককে পাওয়া গিয়েছিল। তাকে আবার বিজিবি সদস্যরা ‘পুশব্যাক’ করেছেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে কক্সবাজার-৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম চৌধুরীকে একাধিকবার মোবাইল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

টেকনাফের বাড়ির দরজায় গুলি

মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে লাগাতার সংঘর্ষের খবরের মধ্যে একটি গুলি এসে পড়েছে কক্সবাজারের টেকনাফের একটি বাড়িতে।

শনিবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের উলুবনিয়া এলাকার নুরুল ইসলামের বাড়িতে এসে গুলিটি পড়লে আতঙ্ক তৈরি হয়।

টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ রোববার বলেন, “সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির খবর পেয়েছি। ফলে আমরা (বিজিবি) সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছি, যাতে নতুন করে কোনো অনুপ্রবেশ না ঘটে।”

গৃহকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, “শনিবার সকাল থেকে উলুবনিয়া সীমান্তের মিয়ানমারের ওপারের মর্টার শেল ও ভারী গুলির শব্দ এপারে ভেসে আসতেছিল। তখন আমরা ভয়ে ও আতঙ্কে নিরাপদে সরে গেছি।

রোববার কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্ত পরিদর্শন করেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান।

“হঠাৎ দেখি একটা গুলির শব্দ হলো। তখন দেখি আমার মেয়ের জামাইয়ের বসতঘরে টিনের দরজা ছিদ্র হয়ে বাড়িতে ডুকে পড়ে একটি গুলি। আমরা আতঙ্কের মধ্যেই পড়ে গেছি।

পরে বিজিবি সদস্যরা এসে বসত ঘরের উঠান থেকে গুলিটা নিয়ে যায় বলে জানান নুরুল ইসলাম।

‘সর্বোচ্চ সতর্ক’ থাকার নির্দেশ বিজিবির

বাংলাদেশের লাগোয়া মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে লাগাতার সংঘর্ষের মধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যদের ‘সর্বোচ্চ সতর্ক’ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এ বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান।

রোববার মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ সংলগ্ন কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্ত পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এ নির্দেশনা দেন বলে বিজিবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

সেখানে বলা হয়, “সম্প্রতি পুরো মিয়ানমারে সংঘাতময় পরিস্থিতি চলছে। যার প্রভাব বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যেও এসে পড়েছে। প্রতিনিয়ত সেখানকার অস্থিতিশীল অবস্থা ও সংঘাতময় পরিস্থিতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে বিজিবি মহাপরিচালক রোববার কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিদর্শন করেন।”

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com