শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪:২১ অপরাহ্ন

রমজানে পাবনা-সিরাজগঞ্জে সাদা দুধের কালো কারবার

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ৫.৩০ পিএম
ছবি: সংগ্রহীত

স্টাফ রিপোর্টার॥

পাবনায় পবিত্র রমজান মাসে প্রতিদিন দুধের চাহিদা ৭০ হাজার লিটার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৩০ হাজার লিটারে। কিন্তু দুধের উৎপাদন বাড়েনি। এদিকে বাড়তি চাহিদার জোগান দিতে তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ নকল দুধ। ছানার টক পানি, স্কিমমিল্ক পাউডার, চিনি, সয়াবিন তেল, হাইড্রোজ, লবণসহ মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নানা ধরনের রাসায়নিক উপকরণ মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করে হাটবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এই দুধ কিনে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে, নকল দুধ খাওয়ার ফলে শরীরের পেছনের অংশে ব্যথা অনুভব, চর্মরোগ, হজমে সমস্যা, পেটের পীড়াসহ নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

জানা যায়, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ মহকুমার শাহজাদপুর থানার বাঘাবাড়ীতে বড়াল নদী পাড়ে স্থাপন করা হয় দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন কারখানা বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা। মিল্কভিটাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪২ সহস্রাধিক গোখামার। এই দুগ্ধ অঞ্চলে প্রাণ, আকিজ, আফতাব, ব্র্যাক ফুড (আড়ং), ফ্রেস মিল্ক, নাভানা মিল্ক, আমোফ্রেস মিল্ক, কোয়ালিটি, বিক্রমপুরসহ বেশকিছু বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ করতে এ অঞ্চলে তাদের আঞ্চলিক ও শাখা দুগ্ধ সংগ্রহশালা স্থাপন করেছে। ফলে তরল দুধের চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। কিন্তু বাড়েনি দুধের উৎপাদন। সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে কেন্দ্র করে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার তাদের জীবিকার পথ হিসেবে গাভী পালন ও দুধের ব্যবসা বেছে নিয়েছেন।

ফলে এ অঞ্চলে গড়ে উঠছে হাজার হাজার গোখামার। এদিকে দুধের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ছানা উৎপাদক ও কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নকল দুধ তৈরি করে বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্রি করেছে। তাদের দেখাদেখি অনেকেই নকল দুধ তৈরিতে উৎসাহিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সিরাজগঞ্জ ও পাবনা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রমজান মাসে পাবনা ও সিরাজগঞ্জে প্রতিদিন দুধের চাহিদা ৭০ হাজার লিটার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ২০ হাজার লিটার। প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হচ্ছে সোয়া পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ লিটার। এই হিসেবে দুধের ঘাটতি থাকছে প্রায় ৭০ হাজার লিটার। অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা কৌশলে নকল দুধ তৈরি করে দুধের এই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, সুজানগর, আটঘড়িয়া এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, বেলকুচি ও কাজীপুর উপজেলার ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা শতাধিক কারখানায় প্রতিদিন প্রায় এক লাখ লিটার দুধের ছানা তৈরি করে। প্রথমে দুধ থেকে শতভাগ ননী (ফ্যাট) বেড় করে নেয়া হয়, পরে ওই ননীবিহীন দুধ জ্বালিয়ে নিম্নমানের ছানা তৈরি করা হয়। ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা ছানার টক পানি ফেলে না দিয়ে ওই ছানার পানির সঙ্গে নানা রাসায়নিক উপকরণ মিশিয়ে তৈরি করে নকল দুধ।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, রমজান মাসে দুধের চাহিদা অনেক বেড়েছে, উৎপাদন কমেছে। এই সুযোগে পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের কিছু কিছু আসাধু ব্যবসায়ী ও ঘোষ নকল দুধ তৈরি করে বিক্রি করছে। তারা প্রতিমণ ছানার পানিতে আধা কেজি সয়াবিন তেল, আধা কেজি স্কিমমিল্ক পাউডার সামান্য পরিমাণ লবণ, খাবার সোডা, এক কেজি চিনি ও দুধের কৃত্রিম সুগন্ধি মিশিয়ে অবিকল দুধ তৈরি করছে, যা রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া আসল না নকল বোঝার উপায় থাকে না। এ দুধ কিনে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছে।

বেড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার অফিস সূত্র জানা যায়, দুধের ল্যাকটো ও ঘনত্ব নির্ণয়ে ল্যাকটোমিটার ব্যবহার করে ভেজাল শনাক্ত করা যায় বলে নকল দুধে চিনি, লবণ, হাইড্রোজ ও সয়াবিন তেল ব্যবহার করে। এতে দুধের ঘনত্ব ও ল্যাকটো বেড়ে যায়। তাজা রাখার জন্য দুধে মেশানো হয় ফরমালিন। ফলে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা কালে ল্যাকটোমিটার দিয়ে এই সূক্ষ্মপ্রতারণা ধরা সম্ভব হয় না।

সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ির খামারি জাকির হোসেন বলেন, গত কয়েক বছর গোখাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। সে তুলনায় দুধের দাম বাড়েনি। দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ৪ দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড (ননীযুক্ত) দুধ প্রতিলিটার ৫৪-৫৭ টাকা দরে কিনছে। এই মানের দুধ খুব কম উৎপাদন হয়। খোলা বাজারে প্রতিলিটার দুধ ৭০-৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বেশির ভাগ খামারি দাদন নেয়ায় তারা দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে কম দামে দুধ সরবরাহ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অব্যাহত লোকসানে খামারিরা গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, তার খামারে শতাধিক গরু ছিল। এখন মাত্র ৩-৪টি গাভী আছে। তাদের দুগ্ধ সমিতিতে আগে ৪৩-৪৪ ক্যান দুধ হতো। এখন মাত্র ৩-৪ ক্যান দুধ পাওয়া যায়। তার মতো অনেকে খামারি গরু বিক্রি করে দিয়েছে অন্য পেশায় চলে গেছে। তাদের কাছে এক সময়ের সম্ভাবনাময় দুগ্ধ শিল্প এখন লাভজনক নয়।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যাপক ডা. শামীম হুসাইন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কেমিক্যাল মিশ্রিত দুধ পান করলে মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। ফরমালিন মেশানোর ফলে হেপাটোটক্সিকিটি বা লিভার রোগ, কিডনি রোগ, ক্ষতিকর মিল্ক পাউডারের ফলে মানবদেহে হাড়ের মধ্যকার দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে। ফলে শরীরের পেছনের অংশে ব্যথা অনুভব, চর্মরোগ, হজমে সমস্যা, পেটের পীড়াসহ নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com