বর্তমান মূল্যস্ফীতির চাপে কমছে ব্যাংকের আমানত। এবার স্কুল ব্যাংকিংয়েও শিক্ষার্থীদের আমানত কমে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই কমছে খুদে শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়। তিন মাসের ব্যবধানে এই আমানত কমেছে ৩৪ কোটি ৩ লাখ টাকা বা ১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে স্কুল ব্যাংকিংয়ে খুদে শিক্ষার্থীদের আমানত ছিল ২ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। পরের মাস আগস্টে তা ১৭ কোটি টাকা কমে ২ হাজার ৩০৮ কোটি হয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে এই সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা, যা আগের মাসের তুলনায় ২১ কোটি টাকা কম।
এদিকে, জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আগস্টে তা আরও বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ হয়, যা ১১ বছরে সর্বোচ্চ। এরপর সেপ্টেম্বরে কিছুটা কমে হয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক দফা রেপো সুদহার বাড়িয়েছে। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, আমানতের পাশাপাশি স্কুল শিক্ষার্থীদের হিসাব সংখ্যাও কমে গেছে। সেপ্টেম্বর শেষে মোট হিসাবসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১ লাখ ৮১ হাজার ৮৬০টি। এ সংখ্যা আগস্টে ছিল ৩১ লাখ ৮২ হাজার ৬৬১। এ সময় গ্রামের শিক্ষার্থীদের হিসাবসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ৫৫০টি আর শহরের শিক্ষার্থীদের হিসাবসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩১০টি। অর্থাৎ শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা সামান্য পিছিয়ে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ব্যাংকগুলো স্কুল ব্যাংকিংয়ের পরিধি বাড়াতে কাজ করছে। এ উদ্যোগের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চয়ের মনোভাব গড়ে ওঠার পাশাপাশি দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতেও তারা অবদান রাখছে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সৃষ্ট মন্দা ও চলমান অর্থনৈতিক সংকট না থাকলে স্কুল ব্যাংকিং প্রকল্পের আওতায় অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ও মোট সঞ্চিতি আরও বেশি হতো।
শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিংসেবা ও আধুনিক ব্যাংকিং প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করার পাশাপাশি সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য ২০১০ সালে স্কুল ব্যাংকিং কর্মসূচি চালু করা হয়। এ কর্মসূচির শুরু থেকে এ পর্যন্ত বেশ ভালোই সাড়া পাচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমের উদ্যোগ নেন। তবে শিক্ষার্থীরা টাকা জমা রাখার সুযোগ পায় ২০১১ সাল থেকে। স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উৎসব এবং পার্বণে উপহার বা নগদ অর্থ পেয়ে থাকে, অথবা নিয়মিতভাবে দুপুরের টিফিন বাবদ যে অর্থ পেয়ে থাকে, তা থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে সঞ্চয়ের মনোভাব গড়ে তোলার জন্যই স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল। এ জন্য স্কুলের কাছের ব্যাংক শাখায় শিক্ষার্থীরা একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলার উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। এখানে ১১ থেকে ১৭ বছরের তরুণ-তরুণী ও ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ব্যাংকিংয়ের জন্য নির্ধারণ করা হয়।
বর্তমানে দেশের ৫৫টি ব্যাংকে স্কুল ব্যাংকিং হিসাব চালু রয়েছে। এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে আছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। ব্যাংক হিসাব চালাতে গ্রাহককে কোনো না কোনো চার্জ দিতে হয়; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে স্কুলের শিক্ষার্থীদের এ হিসাব চালাতে কোনো খরচ দিতে হয় না, চেকবই নিতে গুনতে হয় না কোনো মাশুল। জমা বই, ডেবিট কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিংসহ অন্যান্য সব সুবিধাও রয়েছে স্কুল ব্যাংকিংয়ে। লেনদেন করা যায় যত খুশি। মাত্র ১০০ টাকা আমানত রেখেই এ ধরনের অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের জন্য স্কুল ব্যাংকিংয়ের আমানত মূলত একটি দীর্ঘস্থায়ী আমানত, যা স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগযোগ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ শুরু থেকে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ফলে অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে এসব হিসাবের সঞ্চয়ের পরিমাণ। তবে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির প্রভাবে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হিসাবেও টান পড়েছে। কমে যাচ্ছে এসব হিসাবের আমানতও। কেননা বর্তমানে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের একটি বড় অংশের আর্থিক পরিস্থিতি নাজুক। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগামী ধারার কারণে তাদের আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে। ফলে স্কুল ব্যাংকিংয়েও আমানত কমছে। এ ছাড়া, করোনা মহামারির প্রভাব কমাতে ২০২০ ও ২০২১ এর বেশিরভাগ সময়জুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছিল। ফলে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়