নিজস্ব প্রতিবেদক
সাম্প্রতিককালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দফায় দফায় স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস। কিন্তু ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাস পাওয়ার ব্যবস্থা আবিষ্কার হয়নি। এদিকে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও মোকাবিলার প্রস্তুতি নেই। বহু পুরনো ভবন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, ভবন নির্মাণে নীতিমালা অনুসরণ না করায় ভূমিকম্পঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়েছে বলে মনে করছেন তারা।
ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশের সামর্থ্য বোঝাতে বিশেষজ্ঞরা ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের ঘটনাকে তুলে ধরেন। সে সময় পুরো শক্তি কাজে লাগিয়েও ওই ভবনটি পুরোপুরি উদ্ধারে প্রায় এক মাস লেগে যায়। গত বছরের ২৯ মে দেশের ইতিহাসে প্রথম একই অঞ্চলে একদিনে চার দফা ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। আবহাওয়া ও ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ওইদিন সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৩ মাত্রার, সকাল ১০টা ৫০ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে ৪ দশমিক ১ মাত্রার, বেলা ১১টা ২৯ মিনিট ৫১ সেকেন্ডে ২ দশমিক ৮ মাত্রার এবং দুপুর ১টা ৫৮ মিনিটে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
ভূমিকম্পের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের উত্তর এবং পূর্বাংশের শহরগুলো। রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ এলাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মিয়ানমারের টেকটনিক প্লেটের কাছাকাছি অবস্থান করছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভূমিকম্প সহনীয় দেশ গড়তে নানা ধরনের কার্যক্রম চলমান। সহায়তা পেতে জাপান সরকারের সঙ্গে একটি বড় ধরনের সমঝোতার পথে হাঁটছে সরকার। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক তৈরি, উন্নত যন্ত্রপাতি কেনার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি মহড়ার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার কাজও চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন ও ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেন্ট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চলে রয়েছে। অতীতে বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশ ও আশপাশে হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। এটা কিন্তু হবে। বাংলাদেশের আশপাশে ভূমিকম্পের ইপি সেন্টার বা কেন্দ্র আছে। এই কারণে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। তবে এটা কবে হবে, সেটা বলা যাচ্ছে না। আগামীকাল হবে, নাকি ১০০ বছর পরে হবে, নাকি ২০০ বছর পরে হবে- এটা স্টাডির ব্যাপার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৭ মাত্রার মতো বড় ভূমিকম্প হয়েছে মানিকগঞ্জে ১৮৮৫ সালে। এটার নাম ছিল বেঙ্গল আর্থকোয়াক। আরেকটা হয়েছে শ্রীমঙ্গলে ১৯১৮ সালে, এটার নাম শ্রীমঙ্গল আর্থকোয়াক। ১৮৮৫ সালের ভূমিকম্পে টাঙ্গাইল, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তবে ওই ভূমিকম্পে ঢাকা শহরের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
সাধারণত ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের কেন্দ্র যদি কোনো স্থানের ১০০ কিলোমিটার দূরে হয় তাহলে ওই স্থানের ক্ষয়ক্ষতি কম হয় জানিয়ে এই ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানী বলেন, ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়াক’ ভারতবর্ষে আঘাত হানে। গবেষকরা এখন হিসাব করে বের করেছেন, এটার মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ১। ওই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতের মেঘালয়ের শিলং শহর। ওই ভূমিকম্পে ঢাকা শহরেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
ড. জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের বাউন্ডারির কাছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বড় কোনো ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি (ফল্ট) আমরা চিহ্নিত করতে পারিনি। বাংলাদেশের বাইরে সীমান্ত সংলগ্ন ফল্ট আছে। ত্রিপুরা, মিজোরাম, ডাউকিতে ফল্ট রয়েছে।
অধ্যাপক জিল্লুর রহমান আরো বলেন, আমাদের অবকাঠামোগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা ভূমিকম্প সহনীয় ভবন করি না। এছাড়া অনেক পুরোনো ভবন রয়েছে। এসব ভবন অরক্ষিত (ভালনারেবল), বিপদ (হ্যাজার্ড) আছে- তাই ঝুঁকি তো থাকবেই। অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণের কারণে আমরা নিজেদেরকেই ঝুঁকিতে ফেলেছি।
এদিকে ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি অত্যন্ত নাজুক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের করুণ মৃত্যু হয়। আহত হন আরও কয়েক হাজার শ্রমিক। সরকারের সব সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে পুরো ভবনটি উদ্ধারে সময় লাগে প্রায় এক মাস। এখনো সেই অবস্থা থেকে খুব একটা উন্নতি হয়নি উদ্ধার কার্যক্রমের। তাই ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে শত শত ভবন ধসে পড়লে তা উদ্ধারে তেমন কিছু করার থাকবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেন্ট রেজিলিয়েন্স বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক মো. শাখাওয়াত হোসাইন বলেন, বড় ধরনের ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য আমাদের তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। বিল্ডিং কোড না মানা হলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি আমরা কমাতে পারবো না। পুরোনো ভবনের ঝুঁকি নির্ণয় করে সেগুলো রেট্রোফিট করতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ভূমিকম্প ঝুঁকির ক্ষেত্রে মূল বিষয় হচ্ছে আমাদের ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনীয় কি না। ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে পুরান ঢাকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, ভূমিকম্পের প্রাথমিক প্রস্তুতি কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কী পরিমাণ সরঞ্জাম আছে সেটা নয়। প্রাথমিক প্রস্তুতি হলো বিল্ডিং কোড মেনে ভবনগুলো তৈরি করা হলো কি না।
১৮ কোটি মানুষের জন্য ফায়ার সার্ভিসের জনবল মাত্র ১৩ হাজার। ফায়ার সার্ভিস, রেডক্রস- এদের দিয়ে এককভাবে এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করা যাবে না। জনগণকেই ভলান্টিয়ার হিসেবে তৈরি থাকতে হবে, যোগ করেন ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, বাংলাদেশকে ভূমিকম্প সহনীয় দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে জাপানের সঙ্গে চার দফা মিটিং হয়েছে। আমাদের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক তৈরি হয়েছে।
তিনি জানান, প্রথম দফায় তারা সচেতনতা বাড়াতে কাজ করবেন। দ্বিতীয় দফায় ১০০/২০০ বছরের পুরনো যেসব বিল্ডিং আছে, সেগুলো ধ্বংস করে জাপানের আর্থিক সহতায় ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া সম্প্রতি যেসব ভবন তৈরি করা হয়েছে সেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় কি না তা পরীক্ষার করে সংস্কার করা হবে।
তিনি বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ইর্মাজেন্সি অপারেশন সেন্টার রয়েছে। এছাড়া রয়েছে জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্র (এনডিআরসিসি)। বড় পরিসরে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (এনওইসি) করা হচ্ছে, তেজগাঁওয়ে জায়গা নেওয়া হয়েছে। চীনের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো এমওইউ হবে। এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মানার কোনো বিকল্প নেই। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো দ্রুত ভেঙে ফেলতে হবে। বিপুল সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক গড়ে তুলতে হবে, উদ্ধারকারী সংস্থাগুলোর জনবল বাড়াতে হবে। তারা আরও বলেন, ভূমিকম্প নিয়ে মানুষকে সচেতন করা খুবই জরুরি। পাঠ্যসূচিতে ভূমিকম্পসহ দুর্যোগ মোকাবিলার বিষয়গুলো অর্ন্তভুক্ত করতে হবে।
নতুন ভবন ভূমিকম্প সহনীয় করে বানাতে হবে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ভূতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বলেন, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন করতে হবে। আর পুরনোগুলো রেট্রোফিটিং বা ভূমিকম্প সহনীয় করার জন্য সংস্কার করতে হবে। ঢাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় ভবন করলে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হবে না। এখন থেকে আগামী ২০ বছর যদি আমরা নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ করি তাহলেও ঝুঁকি অনেকটা কমিয়ে আনা যাবে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, দুর্বল ভবনগুলো দ্রুত ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণ করতে হবে। নতুন ভবনগুলো অবশ্যই বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া প্রচুর সংখ্যক ভলান্টিয়ার তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলার মৌলিক বিষয় যুক্ত করতে হবে। তাহলে সচেতন নাগরিক হিসেবে সে গড়ে উঠবে।