রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৮ অপরাহ্ন

ফেসবুকে পরিচয়ে প্রতারণায় বাড়ছে ধর্ষণ

  • আপডেট সময় শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২.০০ পিএম
  • ৩২ বার পড়া হয়েছে

ডেস্ক রিপোর্ট॥

ফেসবুকে বন্ধুত্ব। চলে প্রেমালাপ। একপর্যায়ে দেখা করার প্রবল আগ্রহে মেয়েটি চলে আসে চট্টগ্রামের রাউজানে। স্কুলপড়ুয়া কিশোরী রাউজানে আসার পর দেখে প্রায় ছয় মাস যার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছেন, তিনি ৫৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। কিন্তু সুচতুর এই ব্যক্তি কৌশলে আটকে দেয় তরুণীকে। প্রায় দেড় মাস আটকে রেখে চালান পাশবিক নির্যাতন। পরে কৌশলে পরিবার আর পুলিশের সহায়তায় কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ৫৫ বছর বয়সী প্রতারক-ধর্ষক নাছির উদ্দিনকে।

জানা যায়, নাছির উদ্দিন কয়েক মাস আগে নিজেকে চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি ও তরুণ আইনজীবী পরিচয়ে ফেসবুকে ফেক আইডি খোলেন। মিথ্যে পরিচয়ে ১৭ বছর বয়সী এই তরুণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন।

প্রতারক নাছির চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের একজন টেকনিশিয়ান। ফেসবুকে নাছির তরুণ বয়সের ছবি এবং নিজেকে ১৮ বছর বয়সী পরিচয় দিয়ে ওই তরুণীকে আকৃষ্ট করেন। একপর্যায়ে দেখা করতে রাজি করান। নিজ বাড়ির কাছাকাছি স্থানে সন্ধ্যার দিকে নাছির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে সম্মত হন।

নির্ধারিত দিনে নাছির উদ্দিনের মুখোমুখি হতেই ভুল ভাঙে তরুণীর। তাৎক্ষণিকভাবে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে ঘটনাস্থল থেকে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই নাছির উদ্দিন তরুণীর মুখে রুমাল গুঁজে অজ্ঞান করে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তুলে অপহরণ করে। এর পর থেকে এই তরুণীকে একাধিক আবাসিক হোটেল ও কয়েকটি পৃথক বাসায় বন্দি রেখে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন চালায়।

মেয়ের সন্ধান না পেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে রাউজান থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরিও করা হয়। কিন্তু সম্ভাব্য সব স্থানে খুঁজেও অভিভাবকরা তরুণীর কোনো সন্ধান পেতে ব্যর্থ হন।

এর মধ্যে ওই প্রতারকের কাছে বন্দি থাকা অবস্থায় তরুণী বেশ কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তরুণীটি পালিয়ে আসার কৌশল হিসেবে নিজেকে মানসিক অসুস্থ হিসেবে অভিনয় শুরু করেন। বন্দি থাকা বাসার সবকিছু ভাঙচুর করতে থাকলে নাছির তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়। সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে পরিবারের কাছে ফিরতে সক্ষম হন তরুণী।

বাড়ি ফিরে ঘটনা খুলে বলেন। পরিবারের পরামর্শে ফাঁদ পেতে প্রতারক নাছির উদ্দিনকে তরুণীর বাড়ির কাছাকাছি এলাকায় ডেকে আনা হয়। এ সময় এলাকাবাসী তাকে আটক করে ব্যাপক গণপিটুনি দেয়। পরে তাকে রাউজান থানার পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।

একই রকম ঘটনা ঘটে রাজবাড়ীতেও। স্কুল পড়ুয়া এক ছাত্রীর সঙ্গে সৈকত নামের ফেসবুক আইডির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ওই পরিচয়ের সূত্র ধরে সে মোবাইল ফোনে কথাবার্তা বলা শুরু করে। এক পর্যায়ে গভীর প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করে দেখা করতে গিয়ে ঘটে বিপত্তি। পরে মেয়েটিকে নিয়ে তার এক বাসায় উঠে সেখানে কয়েকদিন তাকে ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে কৌশলে মেয়েটি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের সহায়তায় উদ্ধার হয়। পরে পুলিশ সৈকতকে গ্রেপ্তার করে।

সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ফেসবুকের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে তরুণীরা। ফেসবুকের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের ঘটনা আশংকাজনকভাবে বেড়েছে।

প্রথমে ফেসবুকে অপরিচিত অ্যাকাউন্ট থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। একসেপ্ট করলে পরিচয় হয়। তারপর চলতে থাকে চ্যাট, অনলাইন আড্ডা। আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠ হয়ে দেখা করার প্রস্তাব আসে। দেখা করতে যাওয়া মানেই প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দেয়া। এভাবে অনেক তরুণীকে অপহরণের ফাদ পাতে প্রতারক চক্র। তারপর আটকে রেখে ধর্ষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন, সর্বস্ব বিলীন করে একসময় পতিতালয়ে বিক্রির মতো ঘটনাও ঘটছে।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব বা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে নারীদের যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার বানাচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই আসছে সংবাদমাধ্যমে। এভাবে ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে নারী।

নারীর প্রতি নির্যাতন, সহিংসতা ও ধর্ষণ ঠেকাতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন করেছে সরকার। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সভা-সিম্পোজিয়ামসহ নানাবিধ আয়োজন, কর্মসূচি আয়োজিত হচ্ছে। তবুও থামছে না নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা। অপরাধীর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করলে এসব অপরাধ কমবে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০১৮ সালে ৭৩২ জন, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন ও ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭ জন, ২০২১ সালে ১ হাজার ৩২১ জন এবং ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৫৪৬ জন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের প্রকাশিত তথ্যমতে, ২০১৯ সালে দেশে এক হাজার ৩৭০ জন, ২০২০ সালে এক হাজার ৩৪৬ জন, ২০২১ সালে এক হাজার ২৩৫ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় প্রতি বছরই গড়ে ১ হাজার ২৬০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার প্রায় অর্ধেকই ধর্ষণের।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্যানুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১১ হাজার ৯৫৯টি ফোনকল এসেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ৬১৯টি, ধর্ষণচেষ্টা ৩১৪টি, যৌন নির্যাতন ২৬৮টি, ধর্ষণের হুমকি ৩১টি এবং উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির ১ হাজার ৯টি।

একই অভিযোগে গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ১২ হাজার ১৬৯টি, ২০২০ সালে ৬ হাজার ৩৩১টি, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ১১৫টি এবং ২০১৮ সালে ২ হাজার ২৯২টি ফোনকল আসে।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা হিউম্যান রাইটস ভয়েস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি আব্দুল আওয়াল নয়ন খান বলেন, দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ফলে মৃত্যুদ্লের বিধান রেখে আইন করা হলেও নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ কমছে না। এজন্য অপরাধীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান না দেখে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা প্রয়োজন।

তথ্যানুসন্ধান করে দেখা যায়, সিলেটে জুলি নামের এক নারীর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় হয় ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকার এক তরুণীর। ফেসবুকে তাদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। জুলির আমন্ত্রণে গত ২০ আগস্ট ঢাকা থেকে সিলেটে ঘুরতে যান ওই তরুণী। ওঠেন জুলির বাসায়। সন্ধ্যায় মেয়েটিকে জুলি তার স্বামী জুবায়ের হোসেনের হাতে তুলে দেন। এরপর টানা দুই দিন ওই ভাড়া বাসায় আটকে রেখে সাতজন তাকে ধর্ষণ করে।

গত ১২ আগস্ট জামালপুরের সরিষাবাড়িতে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় স্থানীয় এক স্কুলছাত্রীর ঘরে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করেন কনক হাসান নামের এক ব্যক্তি।

এ ঘটনার মাত্র ছয় দিন আগে গত ৬ আগস্ট গাজীপুরের শ্রীপুরে তাকওয়া পরিবহনের মিনিবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধূ। এর আগে তার স্বামীকে বাস থেকে ফেলে দেয় ধর্ষকরা।

গত পাঁচ বছর ধরে নারী নির্যাতনের ঘটনা ও ধর্ষণের মামলার হার বেড়েছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, বিচার প্রক্রিয়ার দুর্বলতা, দীর্ঘসূত্রতা এবং দোষীদের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

সমাজে নারী-শিশু নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. সানজীদা আখতার বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানসিকতা থেকেই ক্ষমতা প্রয়োগের একটা কুৎসিত রূপ নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ। পর্যায়ক্রমে ওই জায়গাগুলোতে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নারী নির্যাতন, সহিংসতা বা ধর্ষণের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোরও একটা বিরাট প্রভাব।

পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন শিমুল বলেন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে এ ধরনের ঘটছে। এখানে নিজেদের সাবধানতার বিকল্প কিছু নেই।

তিনি বলেন, ফেসবুকে যারা প্রতারণা করা তারা নানা কৌশল ব্যবহার করে। এতে অনেকেই আকৃষ্ট হতে পারে । কিন্তু যাছাই বাছাই করা প্রয়োজন। আবেগের বশবর্তি হয়ে কোন কিছু করতে গেলেই বিপদে পড়তে হয় এটা মনে রাখতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সাইবার ক্রাইম দল ইতোমধ্যে নানা ধরনের প্রতারককে গ্রেফতার করেছে। কোন বিষয়ে সন্দেহ হলেই নিকটস্থ থানা বা পুলিশের বিভিন্ন হটলাইন নম্বর রয়েছে সেখানে কল করে সহযোগীতা পেতে পারে। আমারা সবাই একটু সচেতন হলেই এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে পারি।

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2023 The Daily Sky
Theme Developed BY ThemesBazar.Com